RECENT COMMENTS

’চেঙ্গিস খান’- ত্রয়োদশ শতাব্দীর নিষ্ঠুর যোদ্ধা।


প্রায় সাত শ বছর আগে একজন মানুষ প্রায় পুরো পৃথিবীই জয় করে ফেলেছিলো। নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আবিষ্কার হওয়া অর্ধেক পৃথিবীর অধিপতি হিসেবে, আর মনুষ্য সভ্যতার উপর রাজত্য করেছিলেন ত্রাস দিয়ে এবং তা চলছিলো আরও কয়েক প্রজন্ম ধরে।
তার সৃষ্ট মানব জীবনের এমন ধ্বংষযজ্ঞ কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয় আথুনিক কল্পনাকে- যে কল্পনাশক্তি আমাদের মধ্যে তৈরি হযেছিলো শেষ ইউরোপীয় যদ্ধ থেকে। চেঙ্গিস খান গোবির মরুভূমি থেকে বেরিয়ে আসা একজন উপজাতি গোত্রপ্রধান, পৃথিবীর সমস্ত সভ্য মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো এবং জয়ী হয়েছিলো।
চেঙ্গিস খান ছিলেন মধ্য এশিয়ার ত্রয়োদশ শতাব্দীর যোদ্ধা যিনি ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম সাম্রাজ্য মঙ্গোল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চেঙ্গিজ খান প্রধান মঙ্গোল রাজনৈতিক ও সামরিক নেতা বা মহান খান, ইতিহাসেও তিনি অন্যতম বিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ ও সেনাপতি। চেঙ্গীস খান বহু নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছেন তবে সেই সব নৃশংসতা ক্রুসেডারদের তুলনায় খুব বেশী কিছু যে ছিলো তা মনে হয় বলা যাবেনা। চেঙ্গিস খান কে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লুটেরা বলা হয়।
তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত সাম্রাজ্য চীন এবং মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেছিলো এবং তার সেনাবাহিনী আধুনিক ইউক্রেনের কিয়েভ পর্যন্ত পশ্চিমে অভিযান চালিয়েছিল। চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরীরা মধ্য প্রাচ্য, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের অঞ্চলগুলির সাথে সাম্রাজ্যগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে করেছলো।
জন্ম ও পরিবারঃ ১১৫০ থেকে ১১৬০ সনের মধ্যে কোন এক সময়ে চেঙ্গিস খান জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম ছিলো ইয়েসুকাই। তিনি চল্লিশ হাজার তাঁবু বা পরিবারের নেতা ছিলেন। চেঙ্গিস খানের মায়ের নাম ছিলো হোলুন। কথিত আছে চেঙ্গিস খানের বাবার তার মা কে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে স্ত্রী হতে বাধ্য করেছিলো।
চেঙ্গিস খানের আসল নামঃ সারা পৃথিবীর কাছে তিনি পরিচিত চেঙ্গিস খান নামে কিন্তু তার আসল নাম কিন্তু চেঙ্গিস নয়। “চেঙ্গিস খান” তার উপাধি। “তেমুজিন” তার প্রকৃত নাম। তেমুজিন অর্থ "লোহার" বা "কামার" তার জন্মে সময় তার বাবা অন্য তিমুজিন নামে এক গোত্রের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। তখন চেঙ্গিস খানের জন্ম। যুদ্ধ জয় করে ফিরে এসে শত্রুর নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখলেন ‘তিমুজিন’। আনুমানিক ১২০৬ সালে তেমুজিন যখন সমগ্র মঙ্গোলিয়ান স্তেপের একক অধিপতি হিসাবে আবির্ভূত হন তখন তাকে “চেঙ্গিস খান” উপাধি দেওয়া হয়। যার বাংলা অর্থ খুব সম্ভবত সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি। "খান" একটি ঐতিহ্যবাহী উপাধি, যার অর্থ "নেতা" বা "শাসক।” ইতিহাসবিদরা এখনও "চেঙ্গিস" এর উৎস সম্পর্কে অনিশ্চিত। তবে এটি সম্ভবত "সমুদ্র" বা "ন্যায়সঙ্গত" বোঝাতে পারে, তৎকালীন সময়ে নামটি "সর্বোচ্চ শাসক" বা "সর্বজনীন শাসক" বোঝাতো। হয়ত একারণেই তার পিতৃদত্ত নাম তেমুজিন কালের অতলে হারিয়ে গেছে চেঙ্গিস নামের গৌরব ও পরাক্রমের কাছে।
বাল্যকালঃ বালক চেঙ্গিস খানের অনেক কাজ ছিলো। গ্রীষ্মকাল থেকে শীতকাল পর্যন্ত ঝর্ণা বা নদী তেকে মাছ শিকার করতো। গবাদিপশু ও ঘোড়ারপাল দেখাশোনা করা। ঘোড়ায় চড়ে হারানো পশুগুলো খুঁজে আনা আর নতুন নতুন চারণভূমি খুঁজে বের করা। আক্রমনকারীর খোঁজে রাতের বেলা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকতো আর অনেক বরফঝড়া রাত এভাবে আগুন ছাড়াই কাঁটিয়ে দিতো। প্রয়োজনের তাগিদে বাল্যকালেই তিনি ঘোড়া চালনা শিখছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে নিজ গোত্রের সাথে শিকার অভিযানে যোগ দেয়ার অনুমতি পান। দেশে ফেরার সময়, ইয়াসুখেই প্রতিদ্বন্দ্বী তাতার গোত্রের সদস্যদের মুখোমুখি হয়েছিলো। সেখানে তাকে তাতারদের বিরুদ্ধে অতীতের সীমালঙ্ঘনের জন্য বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছিলো। বাবার মৃত্যুর কথা শুনে চেঙ্গিস খান বাড়ি ফিরে আসেন এবং তেমুজিন বংশের প্রধান হিসাবে নিজের প্রস্তাব পেশ করেন। তবে বংশের অনেকেই ছোট চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
তার পরিবার ও চেঙ্গিস খানের পক্ষে সমর্থন করা এমন কয়েকটি গোত্রকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়। এভাবে অতি কষ্টে তাদের দিন কাঁটতে থাকে। পরবিারের অন্ন যোগানের দায়িত্ব পড়ে তার উপর। তার মা ছিলেন অতি সাহসি একজন মহিলা। সব সময় ছেলেকে সাহস ও সমর্থন দিয়ে গেছেন। একদিন একটি শিকার অভিযানের লুণ্ঠনের মালামাল বন্টন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তার সৎ ভাই বেখটার শিকার করা মাছ চুরি করে এজন্য সৎ ভাইয়ের সাথে তার ঝগড়া হয় এবং তাকে হত্যা করে। গোত্রের সবাই তাকে ভয় পেতে শুরু করে। বাল্যবয়সেই বিভিন্ন সাহসিকতার জন্য গোত্রের সবাই তাকে নেতা হিসেবে মেনে নেয় এবং সমগ্র তেমুজিন বংশের নেতা হওয়ার অবস্থান আরও দৃঢ় হয়।
বিয়ে ও সন্তানঃ ৮ বছর বয়সে চেঙ্গিস খান একদিন তার বাবার সাথে পাশের গোত্রে ঘুরতে বেড়িয়েছিলেন। তারা এক অপরিচিত যোদ্ধার তাবুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো তখন চেঙ্গিস খানের দৃষ্টি পড়েছিলো অপরিচিত ছোট এক মেয়ের দিকে যার নাম বোর্তে। বোর্তেকে দেখে পছন্দ করেন এবং বাবা ইয়েসুকির কাছে জানালেন যে তিনি স্ত্রী হিসেবে মেয়েটিকে পেতে চান। ইয়েসুকি দেখলেন যে, ছেলে ও মেয়ে উভয়ের বয়স অল্প। তিনি মেয়ের সম্বন্ধে সব খোঁজখবর নিলেন এবং মেয়ের বাবার কাছে প্রস্তাব দিলেন। বোর্তে ছিলো চেঙ্গিস খানের চেয়ে বয়সে ১ বছরের বড় অথ্যাৎ ৯ বছর। খুব অল্প বয়স হওয়ার কারণে ইয়েসুকি তখন তাদের বিয়ে দেননি কিন্তু বোর্তের বাবার সাথে ভবিষ্যতে বিয়ের কথা পাকা করে আসেন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে চেঙ্গিস খান বোর্তেকে বিয়ে করেন। চেঙ্গিস খানের  পিতা ওঙ্গিগেরাত গোত্রের বোর্তের সাথে তার বিয়ে দিয়েছিলেন যাতে তাদের দুই গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক আরও ভালো থাকে। বিয়ের পরপরই বোর্তেকে তেমুজিনের প্রতিদ্বন্দ্বী মেরকিট উপজাতি অপহরণ করেছিলো এবং একটি স্ত্রী হিসাবে তাকে একজন রাজ্যপালকে দেওয়া হয়েছিল। তেমুজিন তার বন্ধুর সহযোগীতায় স্ত্রীকে উদ্ধার করেছিলেন এবং নয় মাস পরেই তার প্রথম পুত্র জোচির জন্ম দেন। যদিও মেরকিট উপজাতির সাথে বোর্তির বন্দিদশা জোচির জন্ম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছিল তবুও তেমুজিন তাকে তাঁর নিজের পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। বোর্তির সাথে, তেমুজিনের চার পুত্র এবং অন্যান্য স্ত্রী সহ আরও অনেক সন্তান ছিল, যেমনটি মঙ্গোলিয়ান প্রথা ছিল। তবে, বোর্তির সাথে কেবল তার পুরুষ সন্তানই পরিবারে উত্তরাধিকারের জন্য যোগ্যতা অর্জন করেছিলো।
বোর্তের আরও তিন পুত্র ছিল, ছাগাতাই, এগদেই, এবং টলুই। অন্যান্য স্ত্রীর সাথে তাঁর আরও অনেক সন্তান ছিল, তবে তারা উত্তরাধিকার সূত্রে বাদ পড়েছিলো। কেবল বোর্তির ছেলেরা তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে বিবেচিত হয়। ইয়েসুই নামে এক তাতার মহিলাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর কেবল নাবালিকা স্ত্রী হয়েও সত্ত্বেও বোর্তির মতো প্রায় ততোটা খ্যাতি লাভ করেছিলো। এছাড়া আরও ছয় কন্যার নাম জানা যায় এবং তাঁর জীবদ্দশায় পর্দার আড়ালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চেঙ্গিস খানের ধর্মঃ তিনি শামান ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। শামানরা আকাশ দেবতায় বিশ্বাসী ছিলো। ১২০৬ সালে যখন ঐক্যবদ্ধ মঙ্গোলিয়ার খান নির্বাচিত হন তখন শামান ধর্মের প্রধান পুরোহিত কুকচু ঘোষণা করেন যে আকাশের দেবতাদের পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী চেঙ্গীস খান সমগ্র পৃথিবী শাসন করার জন্যে এসেছেন। চেঙ্গিস নিজেই কুকচুর এই কথা বিশ্বাস করতেন। আর তাইতো ঐক্যবদ্ধ মঙ্গোলিয়ার খান নির্বাচিত হয়ে বলেছিলেন, “আকাশ আমাকে সমস্ত লোককে পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়েছে। চিরস্থায়ী আকাশের সুরক্ষা দিয়ে আমি ক্যারাইটকে পরাজিত করে সর্বোচ্চ পদে পৌঁছেছি।” আর এ কারনেই তিনি তার নতুন নাম নিয়েছিলেন চেঙ্গিস খান বা সারা পৃথিবীর শাসনকর্তা। কিন্তু তার পরও তিনি ছিলেন সব ধর্মের প্রতি অত্যন্ত সহনশীল এবং আপাদমস্তক একজন ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ। তার কড়া নির্দেশ ছিলো সব ধর্মকেই সমান গুরত্ব দিতে হবে এবং কোন ধর্মকেই অন্য ধর্মের উপরে গুরুত্ব দেয়া যাবে না, এমন কি তার নিজের ধর্ম শামানকেও না।
চেঙ্গীস খান সারা জীবনে বহু ধর্মের ধর্মীয় গুরুদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, ইসলাম, তাওবাদ সহ অন্যান্য ধর্ম, তাদের সৃষ্টিকর্তা কিংবা দেবতাদের সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি আদেশ দিয়েছিলান কোন ধর্মের অনুসারীরাই ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে চরমপন্থা অবলম্বন করতে পারবে না। তারপরেও ক্ষমতার ও সাম্রাজ্যবিস্তারের নেশায় মুসলমান ও ইহুদীদের বিরুদ্ধ তিনি একটু কঠোরই ছিলেন। মঙ্গোলীয়ান মুসলমানদের মধ্যে কোরবানী করা নিষেধ ছিলো। মুসলমানরা লুকিয়ে পশু কেরবানী দিতো। তার কাছে মুসলমান ও ইহুদীরা ছিলো ‘দাস’ এর মত।
চেঙ্গিস খানের প্রথম যুদ্ধঃ

(চলমান.......)
Share on Google Plus

0 comments:

Post a Comment