মুসলমানরা যখন "ইনশাআল্লাহ বলে, তারা ভবিষ্যতে
সংঘটিত হবে এমন একটি ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছে বোঝায়। এর আক্ষরিক অর্থ হলো, "আল্লাহ
ইচ্ছা করলে তা ঘটবে” বা ”যদি আল্লাহ চায়।” আমরা যখন ভবিষ্যতের কোন কথা উল্লেখ করবো
বা সিদ্ধান্ত নিবো তখন কেন ‘ইনশাআল্লাহ’ বলতে হয়?
পবিত্র কোরআন মুমিনদের মনে করিয়ে দেয় যে আল্লাহর
ইচ্ছা ব্যতীত আর কিছুই ঘটে না। তাই আমরা নিশ্চিতভাবে নিশ্চিত হতে পারি না যে প্রদত্ত
ঘটনা ঘটবে বা হবে কি না। আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সর্বদা এমন পরিস্থিতি থাকতে পারে
যা আমাদের পরিকল্পনার পথে চলে এবং আল্লাহই চূড়ান্ত পরিকল্পনাকারী। পবিত্র কোরআনে এরশাদ
করেন, ”আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত কোন মানুষ মারা যায় না।" ( সূরা-আল ইমরান, আয়াত-১৪৫)
সুতরাং সব কিছুর পরিকল্পনার মূলে আল্লাহর ইচ্ছা।
ইনশাআল্লাহ বলার গুরুত্বঃ ’ইনশাআল্লাহ’ প্রসঙ্গে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ”তুমি কখনো কোনো বিষয়ে এ কথা বলো না যে, আমি
ওটা আগামীকাল করবো- ‘ইনশাআল্লাহ’ কথাটি না বলে। যদি ভুলে যাও তাহলে তোমার রবকে
স্মরণ করো এবং বলো, সম্ভবতঃ আমার রব আমাকে এর (গুহাবাসীর বিবরণ) চেয়ে সত্যের
নিকটতর পথনির্দেশ করবেন।” (সুরা কাহফ, আয়াত: ২৩-২৪)
যখন আল্লাহর রাসূল (স:) আল্লাহর একত্ব ঘোষণা করেছিলেন
এবং এবং নব্যুয়ত ঘোষণা করেছেন। তখন মক্কার কাফিররা নাযার ইবনে হারিস ও উকবাহ ইবনে মুঈত কে মদিনায় ইহুদি আলেমদের কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন
যে, “আপনারা মুহাম্মাদ (স:) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন, এবং তাদের কাছে তাকে বর্ণনা করুন
এবং তিনি কি বলছেন তা তাদের বলুন।
ইহুদী পন্ডিতরা বলেছেন, ‘তাঁকে তিনটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন;
প্রথমত, প্রাচীন যুগে যুবকদের সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা
করুন, তাদের গল্পটি কী ছিল? একটি অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর গল্প আছে।
দ্বিতীয়ত, এমন একজন ব্যক্তির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করুন
যিনি প্রচুর পরিমাণে ভ্রমণ করেছিলেন এবং পৃথিবীর পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে পৌঁছেছিলেন।
তাঁর গল্পটি কী ছিল? এবং
তৃতীয়ত, তাঁকে জিজ্ঞাসা করুন তিনি রুহ বা আত্মা এটি
কী?
যদি সে যদি এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে তাহলে
বুঝবে সে আল্লাহর রাসুল। আর উত্তর দিতে না পারলে বুঝবে সে মিথ্যা নব্যুয়ত এর দাবী
করছে। সুতরাং আপনি তাঁকে যেমন উপযুক্ত দেখেন তেমন আচরণ
করুন। নাযার ইবনে হারিস ও উকবাহ ইবনে মুঈত মক্কায় ফিরে এলেন এবং বললো, হে লোকেরা! আমরা আপনাদের
নিকটে একটি সিদ্ধান্তমূলক সমাধান নিয়ে এসেছি যা আপনার ও মুহাম্মদ (স:) এর মধ্যে সমস্যার
অবসান ঘটাবে। ইহুদি আলেমরা তাকে আমাদেরকে কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে বলেছেন এবং তারা
সেগুলি তাদের জানিয়েছিল।
অতঃপর কাফিররা রাসূলুল্লাহ (স:)- এর কাছে এসে প্রশ্ন
তিনটি উথ্যাপন করলেন। রাসূলুল্লাহ (স:) বললেন: "তুমি আমাকে যা বলেছ তা সম্পর্কে
আমি তোমাকে আগামীকাল বলবো।
আল্লাহ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহী
ব্যতীত কখনও কোন কিছু বলেননি। সুতরাং এবারও তিনি উক্ত প্রশ্নের উত্তরের জন্য আল্লাহর
পক্ষ থেকে ওহী নাযিলের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু পনেরো দিন কেটে যাওয়ার পরওে জিবরাইল
(আ:) তাঁর কাছে আসেনি।
মক্কার লোকেরা তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে এবং বলতে
লাগলো, ”মুহাম্মদ (স:) পরের দিন আমাদের বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং এখন পনের দিন
কেটে গেছে কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নের জবাবে তিনি আমাদের কিছু বলেননি।” রাসূলুল্লাহ
(স:) ওহী আসতে দেরি হওয়ায় দুঃখ পেয়েছিলেন এবং মক্কার লোকেরা তাঁর সম্পর্কে যা বলেছিল
তাতে দুঃখ পেয়েছিল। অতঃপর জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেন এবং সুরা কাহফ অবতীর্ন
হয়। যেখানে প্রশ্নের উত্তর ছিল এবং ভবিষ্যতে কিছু করার
সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সঠিক শিষ্টাচারের ব্যাখ্যা দিয়ে উপরোক্ত আয়াতটি রয়েছে। (তাফসির ইবনে কাসির)
ভবিষ্যতে কিছু করার সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করা সর্বদা
আল্লাহর ইচ্ছাকে দায়ী করা উচিত। যিনি অদৃশ্যের জ্ঞাত এবং তিনিই একা জানেন যে কী ছিল
এবং কী ঘটেছিল এবং কী হবে না।
‘ইনশাআল্লাহ’ না বলার ফলঃ একবার হযরত সুলায়মান (আঃ) মনোভাব ব্যক্ত করলেন
যে, রাত্রিতে আমি সকল স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হব। যাতে প্রত্যেকের গর্ভ থেকে একটি করে
পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং পরে তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। কিন্তু এ সময়
তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ বলতে ভুলে গেলেন। নবীর এ ভুলটি মহান আল্লাহ তায়াআলা পছন্দ করলেন
না। ফলে, মাত্র একজন স্ত্রীর গর্ভ থেকে একটি অপূর্ণাঙ্গ ও মৃত শিশু ভূমিষ্ট হলো।”
(মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হাদিন নং-৫৭২০) এ প্রসংঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ”আমি তো
সুলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং রেখে দিলাম তার সিংহাসনের উপর একটি নিষ্প্রাণ দেহ।
অতঃপর সে আমার অভিমুখী হইলো।” (সূরা ছোয়াদ, আয়াত-৩৪)।
‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দটি অনেক নবী ব্যবহার করেছেনঃ মুসলমানরা যেসব শব্দ বেশি ব্যবহার করে, তার মধ্যে
একটি হলো ‘ইনশাআল্লাহ’। আগের নবীদের জবানেও ইনশাআল্লাহ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
পবিত্র কোরআন থেকে জানা যায়, আল্লাহর নবী ইয়াকুব, শোয়াইব, খিজির ও ইসমাইল (আ.) কথা
বলার সময় ‘ইনশাআল্লাহ’ ব্যবহার করেছেন। আল্লাহর নবী মুসা (আ.) সৃষ্টিজগতের গোপন
রহস্য সংক্রান্ত বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করতে চাইলেন। এ লক্ষ্যে তিনি খিজির (আ.)-এর
শিষ্যত্ব গ্রহণ করার দরখাস্ত করেন। তখন খিজির (আ.) জবাবে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে
আমার সঙ্গে থাকার ধৈর্য আপনার নেই।’ এ কথার জবাবে মুসা (আ.) বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ’
আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পাবেন। (সুরা কাহফ, আয়াত-৬৭-৬৯)
কোরবানির ঐতিহাসিক ঘটনা প্রায় সবার জানা আছে।
ইবরাহিম (আ.) যখন তার ছেলে ইসমাঈল (আ.)-কে সম্বোধন করে বলেন, ‘হে বৎস! আমি স্বপ্নে
দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এবার চিন্তা করে বলো, তোমার অভিমত কী?’ এমন
ভয়ঙ্কর স্বপ্নের কথা শুনেও ইসমাঈল (আ.) স্বাভাবিক স্বরে বলেন, “আব্বাজান! আপনি
সেটাই করুন। ‘ইনশাআল্লাহ’ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পাবেন।” (সুরা সাফফাত, আয়াত-
১০২)
সুতরাং, যদি ভবিষ্যতে কেউ কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়
বা শপথ করে তবে তার বলা উচিত, 'যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন' বা 'ইনশাআল্লাহ।' যদি কেউ
ইনশাআল্লাহ বলতে ভুলে যায়, যদি এক বছর পরেও তার কথা স্মরণ হয় তখনই বলা উচিত।
আল্লাহপাকের হাবিব প্রিয় বান্দা রাসুল্লাহ (স:)-কেও
ছাড় দেননি। ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলার কারণে রাসুল্লাহ (স:)- এর উপর যদি এত রাগ করতে পারেন-
আর আমরা হাজার লক্ষ মহাসমুদ্র পরিমান গুণা নিয়েও যদি ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলি তাহলে আল্লাহ
আমাদের উপর কি পরমিান রাগ করবেন- এটা একমাত্র আল্লাহপাকই ভালো জানেন।
সুতরাং উপরোক্ত বিভিন্ন ঘটনা থেকে বুঝা যায় আমরা
যখন কোন কাজ করবো বা কথা বলব তখন ইনশাআল্লাহ বলা কত জরুরী! কারন আল্লাহ এর সাহায্য
ব্যতীত কোন কাজই আমাদের দ্বারা করা সম্ভব নয়।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে নেক আমল করার তাওফিক দিন,
আমীন।
0 comments:
Post a Comment