প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহে
সৌদি আরবের মক্কা শহরে কুরাইশ বংশে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট বা আরবি রবিউল আওয়াল
মাসের ১২ তারিখ জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি মানবতার জন্য এক উদাহরণ। তিনি ছিলেন সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তিনি আল্লাহর রাসূল, একজন নবী, শাসক, বক্তা, সৈনিক, স্বামী, বন্ধু,
পিতা, চাচা, ভাগ্নে এবং দাদু হয়ে সর্বস্তরের ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি
ভালোবাসা, ধৈর্য, সাহস, প্রজ্ঞা, উদারতা, বুদ্ধি এবং বিশালতার মানুষ ছিলেন যিনি সারা
বিশ্বের লক্ষ লক্ষ জীবনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন যে তাকে
বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছিলো। "আমি আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি
রহমত হিসাবে প্রেরণ করেছি।" (সূরা-আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)
বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দশম হিজরী সনের পবিত্র
হজের সময় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার সাহাবির সামনে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ বিকালে আরাফাতের
ময়দানে যে খুতবা পেশ করেন, তাকেই বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ বলে। এটি খুতবাতুল ওয়াদা নামেও পরিচিত। এই খুতবাটি অনেক দীর্ঘ
ছিলো এবং এতে অনেক ইস্যুতে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। হজ্ব চলাকালীন মহানবী (স:) এক বিশাল
জনতার সামনে এই খুতবা দিয়েছিলেন। এটি ছিল মানব জাতির
উদ্দেশে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের সর্বশেষ খুতবা বা ভাষণ। নিন্মে ভাষণটি
তুলে ধরা হলো:-
হে মানুষ,
তোমরা আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন, আমি জানি না
এরপর তোমাদের সঙ্গে এই স্থানে আর মিলিত হতে পারব কি-না। তোমরা আমার নিকটে থেকে হজ্জ ও কুরবানীর
নিয়ম-কানূন শিখে নাও। সম্ভবতঃ আমি এ বছরের পর আর হজ্জ করতে পারব না’
হে মানুষ,
সমস্ত মানবজাতি এক আদম ও হাওয়া থেকে এসেছে। এক আরব
অন্য আরবদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব রাখে না এবং কোন আরবকে অন্য আরবের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়
না। একজন সাদাও একজস কালো রঙের চেয়ে বেশি শ্রেষ্ঠত্ব পায় না এবং এ্কজন কালোকেও
কোনও সাদা রঙের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দেয় না। ধার্মিকতা ও সৎকর্ম সম্পাদনই মানষের শ্রেষ্ঠ
দেয়। মনে রেখো প্রত্যেক মুসলমানই প্রতিটি মুসলমানের ভাই এবং মুসলমানরা একটি ভ্রাতৃত্ববোধ
করে। কোন মুসলিমের পক্ষে বৈধ হবে না, যা সহ মুসলিমের অন্তর্গত, যদি না তা নির্দ্বিধায়
এবং স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়। অতএব, তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।
হে মানুষ,
তোমাদের জীবন ও সম্পদ, তোমাদের পরস্পরের কাছে যেমন
পবিত্র, তেমনি আজকের এই স্থান ও দিনটি পবিত্র, এই মাস, এই শহর পবিত্র। জাহেলিয়াতের
সবকিছু আমার পদতলে পিষ্ট, জাহেলি যুগের সব, রক্তের দাবি রহিত করা হলো। ‘মনে রেখ, অপরাধের শাস্তি অপরাধী ব্যতীত অন্যের উপরে
বর্তাবে না। মনে রেখ, পিতার অপরাধের শাস্তি পুত্রের উপরে এবং পুত্রের অপরাধের শাস্তি
পিতার উপরে বর্তাবে না’।
হে মানুষ,
তোমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা
তাদের আল্লাহর কালামের মাধ্যমে হালাল করে নিয়েছ, তোমরা তাদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা
করবে। স্ত্রীদের প্রতি ভালো আচরণ করুন এবং তাদের প্রতি
দয়া করুন, কারণ তারা আপনার অংশীদার এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সহায়ক এবং এটি তোমার অধিকার
যে তারা কারও সাথে বন্ধুত্ব করবে না যার সাথে তুমি অনুমতি না দাও, পাশাপাশি কখনও অসদাচরণ
করো না।
হে মানুষ,
আমার কথা আন্তরিকভাবে শুনুন, আল্লাহর ইবাদত করুন,
আপনার পাঁচটি নফল নামাজ (সালাহ) বলুন, রমজান মাসে রোজা রাখুন এবং আপনার সম্পদ যাকাত
প্রদান করুন। তোমাদের ধর্মের সুরক্ষার জন্য শয়তান থেকে সাবধান থাকুন।
হে মানুষ,
জাহেলী যুগের সূদ পরিত্যক্ত হলো। আমাদের সূদ সমূহের
প্রথম যে সূদ আমি শেষ করে দিচ্ছি সেটা হলো আববাস ইবনু আব্দুল মুত্ত্বালিবের পাওনা সূদ।
সূদের সকল প্রকার কারবার সম্পূর্ণরূপে শেষ করে দেওয়া হলো।
হে মানুষ,
সামর্থ্য থাকলে হজ করবে।
হে মানুষ,
মনে রাখবেন একদিন আপনি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবেন
এবং আপনার কাজের জবাব দেবেন। সুতরাং সাবধান, আমার চলে যাওয়ার পরে ন্যায়পথের পথ থেকে
সরে যাবেন না।
হে মানুষ,
তোমরা তোমাদের দাস-দাসী সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। তোমরা
যা খাবে তাদের তা খেতে দিবে, তোমরা যা পরবে তাদের তা পরাবে। তোমরা তাদের ক্ষমা করে
দিবে, তোমরা কখনো তাদের শাস্তি দিবে না।
হে মানুষ,
তোমরা দিনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না। কারণ অতীতে
বহু জাতি দিনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে ধ্বংস হয়ে গেছে।
হে মানুষ,
আমার পরে কোন নবী বা প্রেরিত আসবেনা এবং নতুন বিশ্বাসের
জন্ম হবে না। সুতরাং লোকেরা, ভাল যুক্তিযুক্ত এবং আমি আপনাকে যা বলেছি তা বুঝতে সাহায্য
করুন।
হে মানুষ,
আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখেছি যাচ্ছি, এক- কুরআন
ও দুই- সুন্নাহ (হাদীস) এবং এগুলি অনুসরণ করলে তোমরা কখনই বিপথগামী হবেন না।
হে মানুষ,
"কাফেররা ক্যালেন্ডারে হস্তক্ষেপ করে যাতে আল্লাহ
যা নিষেধ করেছেন তা জায়েয করতে এবং আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন তা নিষিদ্ধ করার জন্য।
আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোটি। তাদের মধ্যে চারটি পবিত্র, এগুলি যথাসময়ে রয়েছে
এবং একটি জুমদা ও শাবান মাসের মধ্যেই ঘটে।”
হে মানুষ,
আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? লোকেরা বলল, হাঁ। রাসূল (স:)
বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক। উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতগণকে কথাগুলি পৌঁছে দেয়।
কেননা উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকের চাইতে অনুপস্থিত যাদের কাছে এগুলি পৌঁছানো হবে, তাদের
মধ্যে অনেকে অধিক বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছে’।
আমার সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাস করা হবে। তখন তোমরা
কি বলবে? লোকেরা বললো, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি সবকিছু পৌছে দিয়েছেন, দাওয়াতের
হক আদায় করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন’। অতঃপর তিনি শাহাদাত অঙ্গুলি আসমানের দিকে উঁচু
করে ও সমবেত জনমন্ডলীর দিকে নীচু করে তিনবার বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো’
হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো’ হে আল্লাহ! তুমি
সাক্ষী থাকো’।
এই মহান উপদেশের কিছু সুবিধা:
Ø নিরপরাধের রক্ত ঝরানো ও সঠিকভাবে ধন-সম্পদ গ্রহণ
নিষিদ্ধকরণ এবং আত্মার সুরক্ষায় ইসলামের চাপ।
Ø জাহিলিয়াহ (ইসলামের পূর্বে অজ্ঞতা পিরিয়ড) সময়ে
সম্পাদিত কর্মের বৈধতা বাতিল করা)
Ø সুদ গ্রহণ বা সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ, ছোট বা বড় যাই হোক
না
Ø মহিলাদের অধিকার প্রদানের এবং প্রদানের এবং তাদের
সাথে সদয় আচরণের উপদেশ। এক্ষেত্রে অনেক খাঁটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা তাদের অধিকারকে
ব্যাখ্যা করে এবং অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়।
Ø আল্লাহর কিতাবকে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে থাকার পরামর্শ, যাতে
মুসলমানদের সম্মান এবং তাদের বিজয় নিহিত রয়েছে। তেমনিভাবে সুন্নাহর সাথে লেগে থাকার
আদেশ যা কোরআনকে ব্যাখ্যা করে। সন্দেহ নেই যে, আজ মুসলমানদের দুর্বলতার কারণ হ'ল তাদের
আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাহ ত্যাগ করা। এই দুটি সূত্রে ফিরে আসা ছাড়া
মুসলমানদের কোন বিজয় হবে না।
Ø সাহাবায়ে কেরামের সাক্ষ্য যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাঁর আস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে উম্মাহকে
পরামর্শ দিয়েছেন।
Ø নবীজির বাণী, আমল ও স্বচ্ছল চুক্তি থেকে হজ্ব ও অন্যান্য
রীতিনীতি গ্রহণের আদেশ।
Ø নবীজী (স:) শিগগিরই ইন্তেকাল করবেন এমন সূক্ষ্ম ইঙ্গিত।
Ø মুসলমানদের যুদ্ধ ও হত্যার বিরুদ্ধে সতর্কতা।
মূলনীতিঃ
Ø এই স্মরণীয় বক্তৃতায় ইসলামিক কর্মসূচির পাঁচটি মূল
নীতিটির রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে দুটি স্বতন্ত্র স্তরে কাজ করে এবং তিনটি ইসলামী
সমাজের কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। ইসলাম দুটি মৌলিক নীতির ভিত্তিতে মুসলমানের চরিত্রটিকে
রূপ দেয়:
Ø একজন মুসলমানের অজ্ঞতা বা জাহিলিয়াহ, এর প্রতিমা,
অনুশীলন, আর্থিক লেনদেন, সুদের লেনদেন ইত্যাদির সাথে ইসলামের সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন
হয়ে যায়, কারণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ মানেই মুসলমানের জন্য নতুন জীবনের সূচনা যা অতীতের
ভ্রান্ত পথ থেকে সম্পূর্ণ বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে।
Ø সকল প্রকার পাপ থেকে রক্ষা করা। পাপের প্রভাব যুদ্ধে
যে কোনও শত্রু দ্বারা উপস্থাপিত বিপদের চেয়ে অনেক মারাত্মক। নবী এও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন
যে তিনি পাপকে ডুবিয়ে প্রতিমা পূজা করতে শুরু করেননি।
নবীজী তিনটি মূলনীতিও বর্ণনা করেছেন যার ভিত্তিতে
ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে:
Ø ইসলামী ভ্রাতৃত্বের
বন্ধন যা সকল মুসলমানের মধ্যে যথাযথ সম্পর্ককে মোল্ড করে। এই ভ্রাতৃত্ববোধই প্রত্যেক
মুসলমানকে অন্য মুসলমানের পৃষ্ঠপোষক করে তোলে, তাকে যতটুকু সহায়তা দেয়।
Ø দুর্বলদের সমর্থন করা যাতে তাদের দুর্বলতা পুরো সমাজকে
দুর্বল করে না তোলে। একটি বিশেষভাবে লক্ষ করা উচিত যে নবী কীভাবে মহিলাদের প্রতি সদয়
হওয়ার গুরুত্বকে জোর দিয়েছিলেন, যেহেতু তারা সমাজের দুর্বল উপাদান।
Ø ইসলামী আইনটির যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য একটি ইসলামী
সরকার এবং একটি ইসলামী সমাজের সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতা যা সমাজ থেকে সমস্ত মন্দকে অপসারণ
এবং যা ভাল তা দিয়ে প্রতিস্থাপনের জন্য কাজ করে।
Ø মহানবী (স:)- এর বক্তব্যে ইসলাম ও নিখুঁত মুসলিম সমাজের
নিখুঁত বিশ্বাসীর জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত নীতি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তথ্যসুত্রঃ-
islamweb.net/ver2/archive/article.php?lang
বখারী শরাফী, হাদিস নং- ১৬২৩,১৬২৬, ৬৩৬১ ও
উইকিপিডিয়া।
0 comments:
Post a Comment