RECENT COMMENTS

ইয়াসির আরাফাত: এ পলিট্রিক্যাল বায়োগ্রাফি।

ছবি- গুগল

ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষের প্রথম রাষ্ট্রপতি, ক্ষমতাসীন ফাতাহ আন্দোলনের নেতা, পিএলওর প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।
জন্ম ও পরিবারঃ ইয়াসির আরাফাত ১৯২৯ সালের ২৪ শে অক্টোবর মিশরের কায়রোতে বসবাসরত একটি প্যালেস্তিনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
তার পুরো নাম মোহাম্মদ আবদেল রহমান আবদেল-রউফ আরাফাত আল-কুদওয়া আল-হুসিনি। ইয়াসির আরাফাত ছিলেন বাবা মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় কনিষ্ঠ ছেলে। তার বাবার নাম- আবদেল রউফ আল-কুদওয়া। তিনি কায়রো ধর্মীয়ভাবে মিশ্র সাকাকিনি জেলায় একটি টেক্সটাইল ব্যবসায়ী হিসাবে কাজ করেছিলেন। তার মায়ের নাম ছিলো- জাহওয়া আবুল সাউদ এবং জেরুজালেমের অধিবাসী ছিলেন। তিনি তাঁর মায়ের মাধ্যমে হুসেনী পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন, যারা জেরুজালেমের সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন।
১৯৩৩ সালে মাত্র চার বছর বয়সে তার মা কিডনি রোগে মারা যান। মা মারা যাবার পর তার ছোট ভাই ফাথির সঙ্গে মামার বাড়িতে থাকতেন। আট বছর বয়সে, তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন এবং জেরুজালেমে চার বছর কাটানোর পরে আরাফাত তার বাবার সাথে থাকতে কায়রো ফিরে আসেন। বাবার দ্বিতীয় বিয়ে টিকেনি। যখন তার বাবা তৃতীয়বার বিয়ে করেছিলেন, তখন আরাফাতের বোন ইনাম তার ভাইবোনদের লালন-পালনের দায়িত্বে রেখেছিলেন।
কিন্তু বাবার সাথে তার সম্পর্ক ভালো না থাকায়, একত্রে বাস করেননি। এমনও শোনা যায় যে,ইয়াসির আরাফাত ১৯৫২ সালে তাঁর বাবার জানাজায় অংশ নেননি। গাজায় ফিরে এসে বাবার সমাধিতেও যাননি। ইযাসিন আরাফাতের বোন ইনাম, আরাফাতের জীবনী লেখক ব্রিটিশ ঐতিহাসিক অ্যালান হার্টের সাথে একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে কায়রোতে ইহুদি কোয়ার্টারে যাওয়ার জন্য এবং ধর্মীয় সেবার কাজে যোগ দেওয়ার কারণে আরাফাতকে তার বাবা মারাত্মকভাবে পিটিয়েছিলেন। তিনি যখন আরাফাতকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কেন যাওয়া বন্ধ করবেন না, তখন তিনি এই বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন যে তিনি ইহুদি মানসিকতা অধ্যয়ন করতে চান।
বিবাহঃ ১৯৯০ সালে আরাফাত ৬১ বছর বয়সে ফিলিস্তিনির এক খ্রিস্টান সুহা তাওিলকে বিয়ে করেছিলেন। তখন সুহা তাবিলের বয়স ছিলো মাত্র ২৮ বছর। তিউনিসে থাকা অবস্থায় সুহা ইয়াসির আরাফাতের সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করতেন। ১৯৯৫ সালে ইয়াসির আরাফাত কন্যা সন্তানের পিতা হন । আরাফাতের মৃত মায়ের নামানুসারে কন্যার নাম রাখা হয়েছিলো জাহওয়া।
শিক্ষাজীবনঃ ইয়াসির আরাফাত ১৯৪৪ সালে কায়রোর ইউনিভার্সিটি অব কিং ফুয়াদ (কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়ে অন্যান্য আরবদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ফিলিস্তিনের পক্ষে অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে ইহুদিরা সহজেই ফিলিস্তিনিদের পরাজিত করেছিলো। ১৯৪৯ সালের তিনি আবার কায়রো ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় মনযোগ দেন এবং ১৯৫০ সালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
ছাত্র রাজনীতিঃ ছাত্র থাকাকালীন তিনি আরব জাতীয়তাবাদী ধারণা গ্রহণ করেছিলেন । ১৯৫২ সাল থেকে ৫৬ সাল পর্যন্ত জেনারেল ইউনিয়ন অব প্যালেস্টাইনিয়ান স্টুডেন্টস বা জিইউপিএসের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় মিসরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। কিছুদিন কুয়েতে শিক্ষকতাও করেন। ১৯৫৯ সালে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের জন্য ফাতাহ দল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ফাতাহ হরকাত আল-তাহরির আল-ফিলিস্তিনিয়া বা আরবীতে ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিপরীত সংক্ষিপ্ত রূপ। ফাতাহ শব্দের অর্থ বিজয়ী হওয়া। এরপর আমৃত্যু পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রাম করেছেন।আরাফাত তার কিশোর বয়সে হুসেনী পরিবারের চাচাত ভাইদের নেতৃত্বে একটি ফিলিস্তিনি আরব জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর সাথে জড়িত হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে যখন ব্রিটিশরা প্যালেস্টাইন থেকে সরে আসে তখন ইহুদি ও আরব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়াবহ লড়াই শুরু হয়। ফলস্বরূপ, প্রায় দশ মিলিয়ন ফিলিস্তিনি তাদের পৈতৃক স্বদেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল এবং প্রতিবেশী আরব দেশগুলিতে আশ্রয় চেয়েছিল। পূর্ব প্যালেস্তাইনের দুই-তৃতীয়াংশ তখন ইহুদি রাষ্ট্র ইস্রায়েলে পরিণত হয়েছিল। বাকী দুটি আরব প্রতিবেশী মিশর এবং জর্দানের নিয়ন্ত্রণে আসে।
ফিলিস্তিনিদের ১৯৪৮ এর পরাজয়ের পরে আরাফাত কায়রো চলে গেলেন, যেখানে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন। তিনি একটি ফিলিস্তিনি ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা পরবর্তী বছরগুলিতে দ্রুত প্রসারিত হয়েছিল। ১৯৫৮ এর দশকের শেষে এটি নতুন ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন "ফাতাহ" এর অন্যতম অন্যতম প্রধান উপাদান গ্রুপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই গ্রুপের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন । ফাতাহ-এর কার্যক্রম বিভিন্ন আরব দেশগুলির মধ্যে পরিচালিত হয়েছিল এবং সেখান থেকে ইসরাইলি লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ শুরু করেছিল। আরাফাত প্রায়শই ব্যক্তিগতভাবে এই আক্রমণগুলির নেতৃত্ব দেয়।
১৯৬০-এর দশকের শেষভাগে আরব বিশ্বের অনেক জটিল মতাদর্শকে ফতেহ প্রত্যাখাত করেছিলেন এবং বিদ্যমান আরব শাসকদের কোনওটির উপর নির্ভরতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর সদস্যরা যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে ফিলিস্তিনিদের উচিত তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় তাদের নিজের দেশ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করা, যার মধ্যে ইসরাইল বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। এই সশস্ত্র সংগ্রাম ১৯৬৫সালে শুরু হয়েছিল। আক্রমণগুলি ইহুদি সেনাবাহিনীকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেনি, তবে ফিলিস্তিনিদের মনোবল এবং আরাফাতের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছিল।
প্যালেস্তাইন মুক্তি সংস্থা গঠন/পিএলওঃ ১৯৬৪ সালে আরব বিশ্বেরে সহযোগিতায় আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে প্যালেস্তাইন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থাটি প্যালেস্তাইন-এর অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুক্তিকামী দিকে বেশ কয়েকটি দলকে একত্রিত করেছিল। ১৯৭৬ সালের ৫ জুন ইসরাইয়েল-এর সাথে আবার আরব রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিলো। মিশরের বিমানবাহিনীর বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করলে মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধ হয়েছিল। আরবদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধটি শেষ হয়েছিল। পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকাসহ বেশ কয়েকটি আরব অঞ্চল ইসরাইলের দখলে চলে যায়। যদিও আবু নাসের ও তার আরব মিত্রদের পরাজিত করা হয়েছিল, তবুও আরাফাত ও ফাতাহ বিজয়ের দাবি করেছিলো। সেই সময়ে বেশিরভাগ ফিলিস্তিনিই  আরব সরকারের সাথে একত্রিত হয়ে সহানুভূতির প্রকাশ করেছিলো এবং সবাই একমত হয়েছিলো যে 'ফিলিস্তিনি'-দের সমস্যা সমাধান করা অপরিহার্য হয়ে পরেছে। যুদ্ধোত্তর পরিবেশের মধ্যে, আরাফাত এবং ফাতাহ-কে ফিলিস্তিনের ত্রাণকর্তা মনে করা হতো। তিনি ইসরাইলকে মোকাবিলা করার সাহসী জাতীয় বীর হিসাবে বিবেচিত হয়েছিলেন। এতে আরব বিশ্বের ব্যাপক প্রশংসা পাওয়ার সাথে সাথে আর্থিক অনুদান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিলো এবং ফাতাহর অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জামের উন্নতি হয়েছে। কয়েক হাজার অ-প্যালেস্টাইনি সহ বহু যুবক আরব পিএলও-তে  যোগ দেয় বলে এই গোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যায়।
পরবর্তীকালে ইয়াসির আরাফাত ১৯৬৯ সালে পিএলও কার্যনির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হোন এবং ফাতাহ পিএলওর এর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। পিএলও-এর কার্যক্রম জর্ডানে ব্যাপক বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে জর্ডানে বাদশাহ হুসেন ভালোভাবে নিতে পারেননি এবং জর্ডানে সরকারের সাথে সামরিক সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল।
পরবর্তীতে জর্ডানে পিএলও-এর কার্যক্রম বন্ধ করে ১৯৭০ সালে লেবাননে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে ফাতাহ লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় লেবাননের জাতীয় আন্দোলনে সহায়তা করে এবং ইসরাইলের উপর আক্রমণ চালিয়ে যায়। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত লেবানন থেকেই ইসরাইলের উপর আক্রমণের একটি প্রধান ঘাটি হিসাবে পরিণত হয়েছিল। ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে পিএলও লেবানন থেকে বিতাড়িত হয়েছিল
১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩ সাল অবধি ইযাসিন আরাফাত তিউনিসিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এবার তিনি ইসরাইলির সাথে সশস্ত্র সংগ্রাম বা প্রকাশ্য দ্বন্দের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হোন। ১৯৯৪ সালে তিনি ইসরাইলি-প্যালেস্তিনি সংঘাতের দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান চেয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে তিনি ফিলিস্তিনে ফিরে এসে গাজা শহরে বসতি স্থাপন করেন এবং ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলিতে স্বশাসন প্রচার করেন। ইসরাইলি এবং পিএলওর মধ্যে বিরোধের অবসান ঘটাতে ইসরাইলি সরকারের সাথে একাধিকবার আলোচনায় বসেছিলেন।
ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিতঃ প্রথম ইন্তিফাদা বা ফিলিস্তিনি বিদ্রোহের সময় ১৯৮৮সালের ১৫ নভেম্বর, পিএলও ফিলিস্তিনকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। ইহুদীরা এটাকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। ইয়াসির আরাফাত এর  বিরুদ্ধে প্রায়শই সন্ত্রাসবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করতো। তিনি ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর জেনেভাতে জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে 'সন্ত্রাসবাদকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদসহ সকল রূপে' প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং ফিলিস্তিন ও ইস্রায়েল এর "শান্তি ও সুরক্ষার অস্তিত্বের অধিকার" সমর্থন করেন। মার্কিন প্রশাসন তার বক্তব্যকে স্বাগত জানান। আরাফাতের এই বক্তব্যগুলি দুটি পৃথক পৃথক সত্তা প্রতিষ্ঠার দিকে পরিবর্তিত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। ১৯৮৯ আর্মিস্টাইস লাইনের মধ্যে একটি হবে ইসরাইলি রাষ্ট্র এবং অপরটি পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় আরব রাষ্ট্র। এই ঘোষণার ফলে ইসরাইলের সাথে শান্তি আলোচনা হয়। ১৯৮৯ সালের ২ এপ্রিল আরাফাত ফিলিস্তিন জাতীয় কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল, পিএলওর পরিচালনা পর্ষদ ঘোষিত রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
উপসাগরীয় যুদ্ধঃ ১৯৯০-১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের ইয়াসির আরাফাত সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত আক্রমণকে সমর্থন করেছিল এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের ইরাকের আক্রমনের বিরোধিতা করেছিল। তিনি ফাতাহ এবং পিএলওর অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় সদস্যের সম্মতি ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আরাফাতের শীর্ষ সহযোগী আবু আইয়াদ নিরপেক্ষ ছিলেন এবং সাদ্দামের সাথে জোটের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি আবু আইয়াদকে আবু নিদাল সংস্থা হত্যা করেছিল। আরাফাতের এই সিদ্ধান্তের ফলে মিশর এবং তেল উৎপাদনকারী আরব রাষ্ট্রগুলির অনেকের মধ্যে, যারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটকে সমর্থন করেছিল তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে। ফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই আরাফাতকে সন্ত্রাসীর দোসর বলেছিলেন।
১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তিতে স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটি ফিলিস্তিনের জাতীয় কর্তৃপক্ষ তৈরি করে। তবে, ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সাথে সাথে শান্তি প্রক্রিয়াটি ধসে পড়ে।
ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ইতিহাসে হামাস ও ফাতাহ দু'টি প্রভাবশালী দল। হরকাত আল-মুকাওয়ামাহ আল-ইসলামিয়া বা ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো হামাস । হামাস শব্দের অর্থ উদ্দীপনা। গাজায় ১৯৮৭ সালে ইমাম শেখ আহমদ ইয়াসির ও সহযোগী আবদুল আজিজ আল-রন্তিসি প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হওয়ার পরপরই গাজায় হামাস আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরাইলের দখলের বিরুদ্ধে অরাজনৈতিক বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন। এই আন্দোলনটি মুলত মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা হিসাবে শুরু হয়েছিলো এবং প্যালেস্তাইনকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালানোর জন্য ইজ আল-দীন আল-কাসাম ব্রিগেডস নামে একটি সামরিক শাখা তৈরি করেছিল। এটি ইসরাইলি দখলের শিকার ফিলিস্তিনিদের সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচিও সরবরাহ করেছিল। হামাস নিজেকে "ফিলিস্তিনি ইসলামী জাতীয় মুক্তি এবং প্রতিরোধ আন্দোলন" হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে ইসলামকে তার রেফারেন্সের কাঠামো হিসাবে ব্যবহার করে। হামাস বিশ্বাস করে যে ”ইস্রায়েল প্রতিষ্ঠা পুরোপুরি অবৈধ।”
২০০৫ সালে হামাস ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্নপ্রকাশ করেছিলো। ২০০৬ সালের স্থানীয় সংসদ নির্বাচনে ফাতাহাকে পরাজিত করে ব্যাপক জয়লাভ করেছিল। ২০০৭ সালে হামাসের রাজনৈতিক দলিল প্রকাশ হওয়ার সাথে দুটি দলের উদ্দেশ্য কার্যকরভাবে একই- সীমান্তে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন করা। কিন্তু দুটি আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো ইসরাইলের প্রতি তাদের মনোভাব। ফাতেহ ইস্রায়িলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও হামাস কখনোই ইস্রায়িলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। হামাস সশস্ত্র প্রতিরোধ চালিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু ফাতাহ ইসরাইল সাথে আলোচনায় বিশ্বাসী ছিলো এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে, অসলো চুক্তিতে স্বাক্ষর করার আগে দলটি সশস্ত্র প্রতিরোধকে সমর্থন করেছিল। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পরিচালনায় ২০০৭ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দীর্ঘ প্রভাবশালী ফাতাহ দলকে পরাজিত করার পর মাহমুদ আব্বাস ক্ষমতায় আসেন।
দলের ফান্ড সংগ্রহঃ ১৯৮০ এর দশকে আরাফাত লিবিয়া, ইরাক এবং সৌদি আরবের কাছ থেকে মোটা অংকের আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলো, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পিএলও পুনর্গঠনের করতে পেরেছিলো। তাঁর আদর্শ অনুসারে, আরব সরকারগুলির কাছ থেকে আরাফাত সাধারণত তার প্রতিষ্ঠানের অনুদান গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলো, কারণ তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে চেয়েছিলেন। তিনি গ্রুপের ভিতরে কোনরকম বিচ্ছিন্নতা চান নি, এবং আদর্শিক জোটকে এড়িয়ে তাদের অবিভক্ত সমর্থন চেয়েছিলেন। তবে ফাতাহর ভবিষ্যতের আর্থিক সহায়তার ভিত্তি স্থাপনের জন্য তিনি কুয়েত এবং পারস্য উপসাগরের অন্যান্য আরব রাজ্যে যেমন কাতারের (যেখানে তিনি ১৯৬১ সালে মাহমুদ আব্বাসের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন) কর্মরত অনেক ধনী প্যালেস্তিনিদের অবদানের তালিকাভুক্ত করেছিলেন। এই ব্যবসায়ী এবং তেল শ্রমিকরা ফাতাহ সংস্থায় উদারভাবে অবদান রেখেছিলেন। আরাফাত লিবিয়া এবং সিরিয়ার মতো অন্য আরব দেশগুলিতে এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যায়।
২০০২ সালের আগস্টে ইসরাইলি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান অভিযোগ করেছিলেন যে, আরাফাতের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমান ছিলো ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পিএনএর একটি নিরীক্ষা চালিয়েছিলো এবং বলেছিলো যে, আরাফাত নিজের এবং পিএনএর প্রধান অর্থনৈতিক আর্থিক উপদেষ্টার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি বিশেষ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৯০০ মিলিয়ন ডলার পাবলিক ফান্ডে ফিরিয়ে নিয়েছে। এই তহবিলের বেশিরভাগ অর্থ অভ্যন্তরীণ ও বিদেশে ফিলিস্তিনের সম্পদে বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো।
শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ঃ ১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত, ইসরাইলি রাজনীতিবিদ শিমোন পেরেস এবং ইয়েজক রবিন কে মধ্য প্রাচ্যে শান্তি তৈরির প্রচেষ্টার জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ইয়াসির আরাফাত ইউএন জেনারেল অ্যাসেমব্লিকে ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তিনি এক হাতে শান্তির জন্য জলপাইয়ের শাখা এবং অন্য হাতে একজন মুক্তিযোদ্ধার পিস্তল রাখছিলেন। বিশ বছর পরে তিনি এবং ইসরাইলি নেতা পেরেস এবং রাবিন ওয়াশিংটনে তথাকথিত অসলো অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করে জলপাই শাখার পক্ষে যাওয়ার জন্য শান্তি পুরষ্কার পেয়েছিলেন। চুক্তিটি ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে পুনর্মিলনকে লক্ষ্য করে করা ছিল।
মৃত্যুঃ ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর ভোরে ফ্রান্সের সামরিক হাসপাতালে ৭৫ বছর বয়সী ইয়াসির আরাফাত মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি কখনো কফি খেতেন না, এ্যালকোহল তো নয়ই। সন্ধ্যেবেলা বেশি খাওয়া দাওয়া করতেন না। শুধু চা খেতেন মধু দিয়ে, আর একটুখানি পনির। স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই যত্নশীল।
অনেকের মতে, তার মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিলো না। ১২ অক্টোবর রাতের খাবার খাওয়ার প্রায় চার ঘন্টা পরে তার গুরুতর বমিভাব, পেটে ব্যথা এবং ডায়রিয়া শুরু হয়। এরপর কয়েক সপ্তাহ ধরে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার পরে তাকে পশ্চিম তীরে তার সদর দফতর থেকে ফ্রান্সের সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছিলো। ফরাসী চিকিৎসকরা বলেছেন যে, তিনি স্ট্রোকের কারণে মারা গিয়েছেন। ইয়াসির আরাফাত মৃত্যুর পর তার কোনও ময়নাতদন্ত করা হয়নি। কিন্তু দীর্ঘ ২০১২ সালে সুইস বিজ্ঞানীরা আরাফাতের স্ত্রীর অনুমতিতে, তার মৃত্যু রহৎ নিয়ে গবেষণা করেন। সুইস বিজ্ঞানীরা তার দেহ নিঃসরণের পরে আরাফাতের দেহাবশেষ নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। তারা আরাফাতের পাঁজর, পেলভিস এবং মাটিতে যে শারীরিক তরল শোষণ করে তার চেয়ে কমপক্ষে ১৮ গুণ বেশি পোলোনিয়ামের মাত্রা আবিষ্কার করেছিলেন। সুহা আরাফাত বলেছিলেন যে প্রতিবেদনে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে তার তৎকালীন সুস্থ ৭৫ বছর বয়সী স্বামী, যিনি ২০০৪ সালে খাওয়ার পরে প্রথম অসুস্থ হয়ে পড়ার চার সপ্তাহ পরে মারা গিয়েছিলেন, প্রায় অবশ্যই বিষক্রিয়া দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল। তিনি আল-জাজিরাকে বলেছেন: "এটি এই শতাব্দীর অপরাধ।"
ফিলিস্তিনিরাও মনে করেছিলেন ইসরায়িলিরা ইয়াসির আরাফাতকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছে। কেননা তার মৃত্যু দুর্ঘটনাও ছিল না, স্বাভাবিকও ছিল না। অনেকের মতে, আরাফাত ইসরায়েলের গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছিলেন। ইস্রায়েল বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে আরাফাতকে হত্যার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সাধারণত নিজেরাই এজেন্ট ব্যবহার করে নি বরং সাধারণত ফিলিস্তিনিদেরকে ব্ল্যাকমেল করে ইয়াসির আরাফাততে মারার প্লান করতো।, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আরিয়েল শ্যারন ইয়াসির আরাফাতকে ’ইহুদীদের খুনি’ মনে করতো।
আরাফাতের মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়া হলে ফিলিস্তিনি জনগণ শোকে ভেঙ্গে পড়ে। পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা জুড়ে মসজিদের লাউডস্পিকার থেকে শোক প্রার্থনা করে এবং রাস্তায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষনা দেয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং লেবাননের শরণার্থী শিবিরগুলি ৪০ দিনের শোক ঘোষণা করেছে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াঃ ২০০৪ সালে ১১ নভেম্বর, ফরাসি সেনাবাহিনীর আরাফাতের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত গার্ড অফ অনার অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলো। তার কফিনের উপর ফিলিস্তিনের পতাকা টানানো ছিল। একটি সামরিক ব্যান্ড ফরাসী ও ফিলিস্তিনের জাতীয় সংগীত এবং একটি চপিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বাজায়। ফরাসি রাষ্ট্রপতি জ্যাক চিরাক আরাফাতের শ্রদ্ধার সর্বশেষ অনুষ্ঠানে প্রায় দশ মিনিট আরাফাতের কফিনের পাশে একাকী দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আরাফাতের "সাহসী মানুষ" বলে সম্বোধন করেছিলেন। পরের দিন, আরাফাতের মরদেহ প্যারিস থেকে একটি ফরাসী বিমানবাহিনীর বিমানে করে মিশরের কায়রোতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে সংক্ষিপ্ত সামরিক জানাজার জন্য বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। মিশরের শীর্ষ মুসলিম আলেম সাইদ তানতাভির জানাজা শুরুর আগে শোকের নামাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
পরিশেষঃ ইয়াসির আরাফাত তার সমর্থকদের চোখে ছিলেন ফিলিস্তিন জাতীয়তাবাদের পিতা। অন্যদিকে ইসরায়েলিদের চোখে ছিলেন একজন সন্ত্রাসী। জাতিসংঘের প্রাক্তন সেক্রেটারি-জেনারেল কফি আনানের বলেন, ”আরাফাত এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে ছিলেন এবং তার প্রতীকী হয়ে উঠছিলেন।” ফিলিস্তিনির স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য দীর্ঘ ৪০ বছর ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গেছেন- এজন্য এই মহান নেতাকে আমরা ফিলিস্তিনির একজন মুক্তিযোদ্ধা মনে করতে পারি।
তাঁর জীবনে এবং এখন তাঁর মৃত্যুর পরেও আরাফাত আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং গুরুত্বপূর্ণ আরব রাজনীতিবিদ হিসাবে রয়েছেন এবং থাকবেন।

হিটলার-এর জীবনী পড়ুন=>>


তথ্যসূত্রঃ
Yasir Arafat: A Politicao Biography- Barry RubinJudith Colp Rubin
www.paljourneys.org/en/biography/6562/yasir-arafat
www.ukessays.com/essays/history/history-of-yasser-arafat-history-essay.php
Wikipedia
Share on Google Plus

0 comments:

Post a Comment