"অপেক্ষা"
সকাল ১০
টার মধ্যেই ট্রেন চলে আসবে অথচ রিক্সা এখনো জ্যামে আটকে আছে। আকব রিক্সা থেকে
দাঁড়িয়ে জ্যামের অবস্থা দেখার চেষ্টা করছে। ফকিরাপুলে কখনো এত জ্যাম হয় না। তবুও
আজ প্রচন্ড জ্যাম। আকব রিক্সা থেকে নেমে হাঁটা দিলো।
যে করেই হোক ১০ টার
ভিতর রেল স্টেশনে পৌছাতে হবে। নয়তো এত লোকে ভিতর বাবাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আকব পৌছে গেল স্টেশনে। ট্রেন এখনো পৌছায় নি। পরপর দুটি
ট্রেন ছেড়ে যাওয়াতে পুরো প্লাটফর্মটি অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। ওয়েটিং রুম নিশ্চব্ধ
হয়ে আছে। এ নিশ্চব্ধতা কারো ভাল লাগে না। আকবেরও ভাল লাগেনি। সে একটি যাত্রা
ছাউনীতে গিয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো । প্রচন্ড গরম ও টেনশনে মাথা চিনচিন
করে ব্যাথা করছে। চোঁখ বন্ধ করে আকব ভাবছে বাবাকে দেখার পর কিভাবে ডাক দিবে।
বাবাকে বাবা বলে ডাক দেয়াতে কোন লজ্জ্বা নেই কিন্তু তার একটু লজ্জ্বা লাগছে। এ
লজ্জ্বা সময়ের!
স্যার দুইটা টেকা
দিবেন? আকব পকেটে হাত ডুকিয়ে বিশ টাকা বের করে দিলেন। ফকির বিশ্বাস করতে পারছে না
দুই টাকা চাওয়াতে বিশ টাকা পেয়ে যাবে। রেল লাইনের ওপারে হুইল চেয়ারে বসে আছে
ফকিরের সঙ্গীনি। একটি ট্রেন প্লাটফর্মে ডুকছে। তবুও মানুষটি ওপারে যেতে ছুটে চললো
প্রিয় সংঙ্গীনিকে সংঙ্গ দেয়ার টানে। কিন্তু জীবনের সাথে পেরে উঠলেও ট্রেনের গতির
সাথে পেরে উঠা হয়নি তার। চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায় নিথর দেহ পড়ে রইলো এপারে। মানুষ
চাইলেও তার ভালবাসার কাছে যেতে পারে না।
আকব ভেবে পাচ্ছে না
ঘটনাটি। গতকাল রাতে হুবহু এরকম একটি স্বপ্ন দেখেছিল। আগের সপ্তাহ্ আরও দুটি স্বপ্ন
দেখেছিল। তার ঘরের সিলিং ঘেসে অনেকগুলো সাপ ঘোরাফেরা করছে। অন্যটি নিজের কাফন
জড়ানো লাশ। বাতাসে মুখের কাপড়টি খুলে গিয়েছিল। নিজের চেহারাটি স্পষ্ঠ দেখতে
পেয়েছিল। এ সবের অর্থ কি? এগুলো কিসের বার্তা? সৃষ্টকর্তাই জানেন। নাহ্, এসব নিয়ে
ভাবতে চাইছে না। কপালের দু'পাশে আঙুল চেপে বসে রইলো আকব।
দুপুর ১টা বাজে।
যাত্রী ছাউনীর ভিতর রৌদ ডুকে গেছে। অথচ তার বাবা যে ট্রেনে আসবে সেই ট্রেন এখনও
আসেনি। কিছুটা দুরে দাঁড়িয়ে একজন মধ্য বয়স্ক মানুষ বুক চাপড়ে চিৎকার করছে। হে
আল্লাহ্ আমি কি করেছি? কেন এত বড় শাস্তি দিলে আমায়? আত্নবিলাপ করে চলছে। হ্যাঁ,
আমরা অনেক সময় সৃষ্টিকর্তার দেয়া শাস্তির কোন কারন খুঁজে পাই না। হয়তো বা বহু বছর
আগে বাসায় কাজের বাচ্চাকে নির্যাতন করা, ভিক্ষুক অসহায়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করা।
পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বেও টাকা নেই বলে গাড়ি ভাড়া না দেয়া। হিংসা, পরনিন্দা,
পরশ্রীকাতর এরকম অসংখ্য পাপের কোন কিছু করেছিল লোকটি। খুব সহজেই এসব পাপের কথা
আমরা ভুলে যাই। যখন সৃষ্টকর্তার শাস্তি মাথায় এসে পড়ে তখন আমরা বুক চাপড়ে বলতে
থাকি- হে আল্লাহ্! কি করেছি আমি? কেন এত বড় শাস্তি দিলা? মনে হয় সব দোষ যেন
সৃষ্টিকর্তার! অথচ অতীতের ঐসব পাপের কথা আমাদের বেমালুম বিস্মৃতি হয়ে গেছে। এজন্য সৃষ্টকর্তা,
মানুষের কিছু কিছু পাপের শাস্তি এই দুনিয়াতে দিয়ে দেন; অন্য মানুষদের সতর্ক করার
জন্য।
বিকেল ৪টা পঁনেরো
মিনিট;
আকব ভেবে পাচ্ছে না- সে
কি করবে এখন। সে কি বাস্তবে বসে আছে? নাকি এটিও তার আরেকটি দুঃস্বপ্ন! একটি ট্রেন
ছেড়ে যাওয়ার বাঁশি বেঁজে উঠলো। সে দাঁড়িয়ে ট্রেনটির চলে যাওয়া দেখতে লাগলো। অনেকটা
দুর চলে যাওয়ার পর মনে হলো ট্রেনটি আর চলছে না। ঠিক যেন স্থির হয়ে আছে এক জায়গাতে!
পরক্ষনে ট্রেনটি উধাও হয়ে গেল। আশ্চার্য! মানুষের জীবনটাও এমন। বাড়ন্ত বয়স খুব
দ্রুত কেঁটে যায়। কিন্তু একটা সময় মনে হয় জীবন আর চলছে না। স্থির হয়ে আছে এক
জায়গাতে। বয়সের শেষ প্রান্তে এসে মানুষ বুঝতে পারে অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেছে তার
জীবন থেকে। তখন মৃত্যুকে কল্পনা করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়া কিছুই করার থাকে না! ক্লান্ত
আকব প্লাটফর্ম ধরে হেঁটে চলছে ছোট ছোট কদমে। ১৬ বছর কেঁটে গেছে;
ট্রেন এখনো আসেনি
..... !
#শরশ_দিগন্ত
0 comments:
Post a Comment