বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ই-কমার্স উদ্যোক্তা চীনের জ্যাক মা। চীনের দ্বিতীয়
এবং বিশ্বের ১৯ তম ধনী বলা হয় তাকে। তিনি আলিবাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান।
বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি মানুষ প্রতিদিন এখন আলিবাবার মাধ্যমে কেনাকাটা করে। আলিবাবায়
কাজ করে প্রায় সাড়ে ৬৬ হাজার কর্মী। তিনি আগামী বছর কোম্পানির ২০ তম বার্ষিকিতে কোম্পানির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে
দাঁড়ানোর ঘোষনা দেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ইং তারিখে, আলিবাবার গ্রাহক ও
হোল্ডারদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়। চিঠিতে
তিনি আলিবাবার প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য, বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ
করেন। আলিবাবার
গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশ্যে লেখা জ্যাক মা’র ওই চিঠিটি হুবহু এখানে তুলে
ধরা হলো:-
প্রিয় আলিবাবা ও শেয়ার হোল্ডার,
আজ আলিবাবার ১৯তম বার্ষিকীতে, আমি আপনাদের সঙ্গে
কিছু তথ্য শেয়ার করতে চাই। বোর্ড অব ডিরেক্টরদের সম্মতিতে আগামী বছর ১০ সেপ্টেম্বর
আলিবাবার ২০তম বার্ষিকিতে গ্রুপের সিইও ড্যানিয়েল ঝ্যাঁ আলিবাবা গ্রুপের বোর্ড অব
চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। আগামী ১২ মাস নির্বাহী চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায়
একটি মসৃণ ও সফল হস্তান্তরের পর ড্যানিয়েলের সঙ্গে আমি আন্তরিকভাবে কাজ করবো। তাই
আগামী ২০২০ সালে শেয়ার হোল্ডারদের বার্ষিক মিটিংয়ের আগ পর্যন্ত আমি আলিবাবার বোর্ড
অব ডিরেক্টরে থাকবো।
দশ বছর ধরে আমি ভেবেছি আমার উত্তরসূরী কে হবে এবং তা নিয়ে আমি
প্রস্তুতি নিয়েছি। আমি আজ আনন্দিত সেই
ঘোষণা দিতে পারার জন্য। আলিবাবা পার্টনারশিপ এবং আমাদের বোর্ড অব ডিরেক্টরদের
ধন্যবাদ জানাই। আমি আলিবাবার সব সহকর্মী এবং তাদের পরিবারকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে
চাই, কারণ গত ১৯ বছর আপনাদের বিশ্বাস, সমর্থন এবং আমাদের যৌথ প্রচেষ্টায় আস্থা এবং
শক্তির মাধ্যমে এই দিনটির জন্য প্রস্তুত হতে পেরেছি। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই
বিষয়টির মাধ্যমে বোঝা যায় যে, আলিবাবা কোম্পানি থেকে করপোরেট গভর্নেন্সে উন্নীত
হয়েছে, যেখানে ব্যক্তি নয় বরং সাংগঠনিক দক্ষতা ও মেধা উন্নয়নের সংস্কৃতিরই
প্রাধান্য।
১৯৯৯ সালে যখন আলিবাবা প্রতিষ্ঠা পায় তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল এমন
একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা যা চীন তথা বিশ্বকে গর্বিত করবে এবং যেটি তিন শতক
অতিবাহিত করে ১০২ বছর টিকে থাকবে। যদিও আমরা সবাই জানতাম যে, কেউই এই কোম্পানিতে
১০২ বছরের জন্য থাকতে পারবো না। সুশাসন, সংস্কৃতি কেন্দ্রিক দর্শন এবং ধারাবাহিক
মেধার উন্নয়নের মাধ্যমেই একটি টেকসই আলিবাবা গড়ে তুলতে হবে। কোনও কোম্পানিই শুধু
এর প্রতিষ্ঠাতাদের ওপর নির্ভরশীল থাকরতে পারে না। সব মানুষের মধ্যে এটি জানা উচিত।
কারণ দক্ষতা ও শক্তির যে শারীরিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এর ফলে কেউই সারাজীবন
চেয়ারম্যান এবং সিইও’র দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।
জ্যাক মা কোম্পানি ছেড়ে গেলে কীভাবে আলিবাবা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন
করতে পারবে? এই প্রশ্ন ১০ বছর আগেই আমরা নিজেদের করেছি। করর্পোরেট নেতৃত্ব
হস্তান্তরের এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় ধারাবাহিকভাবে মেধার উন্নয়ন এবং
উত্তরসূরী তৈরির জন্য একটি নিজস্ব সংস্কৃতি ও মেকানিজমের ভিত্তিতে সুশাসন
ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। বিগত ১০ বছর ধরে আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করেছি।
আমার যা অর্জন ও শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষিত হতে পেরে আমি খুবই
গর্বিত । শিক্ষকরা সবসময় চান যে তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদেরকে ছাড়িয়ে যাক। তাই
আমিও মনে করি কোম্পানির জন্য দায়িত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তরুণ, মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের
নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া; যাতে তারা আমাদের ‘যে কোন জায়গায় ব্যবসা কে এগিয়ে নিয়ে
যেতে পারে। ক্ষুদ্র ব্যবসা, তরুণ ব্যক্তি এবং বিশ্বজুড়ে নারীদের সাহায্যে এই মিশন
চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার আসক্তি। ব্যবসার প্রথম দিন থেকে এটি কেবল আমাদের ইচ্ছাই
ছিল না বরং এ ধরনের সুযোগ পেয়ে আমি সৌভাগ্যবান। এই মিশনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে শুধু
জ্যাক মা নয় বরং আরও অনেক মানুষ এবং আলিরেনের প্রজন্মের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা
প্রয়োজন।
আলিবাবা খুব বিস্ময়কর! তবে এটি আমাদের ব্যবসা বা পরিধি বা অর্জনের
জন্য নয়। আলিবাবার ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো বিষয় হচ্ছে একটি একই মিশন ও ভিশন নিয়ে
আমরা কাজ করছি। আমাদের পার্টনারশিপ সিস্টেম, নিজস্ব সংস্কৃতি ও মেধাসম্পন্ন দল
আমাদের কোম্পানির লিগ্যাসির জন্য শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে। বস্তুত ২০১৩ সালে
যখন সিইও’র দায়িত্ব ছেড়ে দিই তখন এই প্রাতিষ্ঠানিক উপাদানগুলোর ওপর ভর করেই
কোম্পানি মসৃণ চলেছে।
সুশাসন ও টেকসইয়ের জন্য আমরা এই পার্টনারশিপ ব্যবস্থার উন্নয়ন
ঘটিয়েছে, যা অবিরাম উদ্ভাবন, নেতৃত্ব, জবাবদিহিতা এবং সাংস্কৃতিক চলমানতা
কোম্পানির বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজে দিয়েছে। আমাদের ব্যবস্থাপনা মডেলকে একটি
জায়গায় দাঁড় করাতে আমরা সিস্টেম এবং ব্যক্তির মধ্যে সঠিক ভারসাম্যের উন্নয়ন ঘটাতে
বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। শুধু কোনও ব্যক্তি বা অন্ধের মতো একটি সিস্টেম
অনুসরণ করলে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। দীর্ঘমেয়াদী টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য
সিস্টেম, মানুষ ও সংস্কৃতির মধ্যে ভারসাম্য প্রয়োজন। আমার পুরোপুরি বিশ্বাস যে আমাদের
পার্টনারশিপ সিস্টেম এবং আমাদের সংস্কৃতি সুরক্ষার চেষ্টা গ্রাহক, কর্মী ও শেয়ার
হোল্ডারদের ভালোবাসা ও সমর্থন আদায় করে নেবে।
১৯৯৯ সালে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা লাভের পরই বুঝতে পেরেছি আমাদের
ব্যবস্থাপনা উত্তরসূরী পরিকল্পনায় বাস্তবায়নের জন্য আলিবাবার ভবিষ্যৎ ‘মেধার পালের’
ওপর নির্ভর করতে হবে। বহু বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর, আজ আলিবাবায় মান ও পরিমাণে
বিশ্বমানের একদল মেধাবি লোক রয়েছে। আমার ভেতরকার শিক্ষক আমাদের টিম, নেতৃত্ব এবং
আমাদের নিজস্ব মিশননির্ভর সংস্কৃতি ড্যানিয়েল ঝ্যাঁ’র মতো ব্যতিক্রমী ব্যবসায়ী
নেতা এবং প্রফেসনাল মেধার নিয়মিত উন্নয়ন ঘটাতে পেরে আমার ভেতরকার শিক্ষক আমাদের
টিম, নেতৃত্ব এবং আমাদের নিজস্ব মিশননির্ভর সংস্কৃতি নিয়ে খুবই গর্বিত।
ড্যানিয়েল, আলিবাবা গ্রুপের সঙ্গে ১১ বছর ধরে আছে। সিইও হিসেবে
দায়িত্ব নেয়ার পর সে তার নিখুঁত মেধা, ব্যবসায়িক অন্তর্দৃষ্টি এবং নেতৃত্বের দৃঢ়তা
দেখিয়েছেন। তার অধীনে টানা ১৩ কোয়ার্টারে আলিবাবার ধারাবাহিক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি
হয়েছে। তার বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা অদ্বিতীয়। সে আমাদের মিশন ও ভিশনকে আগলে রাখেছে,
আন্তরিকতার সাথে তার দায়িত্ব পালন ও ব্যবসায় মডেলের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল
পরীক্ষা চালানোর মত দুঃসাহস তার রয়েছে। চীনের ব্যবসা ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম তাকে
২০১৮ সালে এক নাম্বার সিইও হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কারণে সে এবং তার টিম
গ্রাহক, কর্মী ও শেয়ার হোল্ডারদের আস্থা ও সমর্থন জিতে নিয়েছে। ড্যানিয়েল ও তার
টিমের কাছে সঠিক সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তর যথাযথ সিদ্ধান্ত, কারণ তাদের সঙ্গে কাজ করে
আমি জেনেছি যে, তারা প্রস্তুত এবং আমাদের পরবর্তী নেতৃত্বের উপর আমাদের পুরোপুরি
আস্থা রয়েছে।
আর আমার কথা বলতে গেলে, এখনও অনেক স্বপ্ন ছোঁয়া বাকি আছে। যারা
আমাকে চেনন, তারা জানেন আমি অলস বসে থাকতে পছন্দ করি না। আলিবাবা পার্টনারশিপে প্রতিষ্ঠাতা
অংশীদার হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করে যেতে যাই এবং পার্টনারশিপে অবদান রাখতে
চাই। আমি আবারও শিক্ষকতায় ফিরে যেতে চাই কারণ শিক্ষকতা করতে আমি খুব পছন্দ করি।
বিশ্বটা অনেক বড় এবং আমি এখনও তরুণ, তাই আমি নতুন কিছু করতে চাই- কেননা যদি নতুন
স্বপ্ন পূরণ হয়?
একটি বিষয় আমি সবাইকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি- আলিবাবা কখনও জ্যাক
মা কে নিয়ে নয়, বরং জ্যাক মা সব সময়ই আলিবাবার থাকবে।
জ্যাক মা
নির্বাহী চেয়ারম্যান
আলীবাবা গ্রুপ হোল্ডিং লিমিটেড
সাবেক
এই ইংরেজি শিক্ষক জ্যাক মা ১৯৯৯ সালে আলিবাবা প্রতিষ্ঠা করেন। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার
ইনডেক্সের তথ্য মতে, তিনি বিশ্বের ১৯ তম শীর্ষ ধনী। ওই সূচকে বিশ্বের শীর্ষ ধনী আমাজনের
প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোসের সম্পদের পরিমাণ ১৬ হাজার ১০০ কোটি
মার্কিন ডলার বলা হয়েছে। অপরদিকে ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০১৮ সালের বিলিয়নেয়ারের
তালিকায় জ্যাক মার সম্পদের পরিমাণ হয় ৩ হাজার ৯৯০ কোটি ডলার। তিনি বিশ্বের ২০তম ও
চীনের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। তবে সর্বশেষ হিসাবে তার সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২০০
কোটি ডলার। ফরচুন ম্যাগাজিনের ২০১৭ সালের বিশ্বের ৫০ গ্রেটেস্ট লিডারের মধ্যে
জ্যাক মা দ্বিতীয়।
তথ্য সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অনলাইন আরটিভি নিউজ ও ইন্টারনেট।
0 comments:
Post a Comment