RECENT COMMENTS

"লোকাল সিটিং"- একটি চোঁখ ও একটি কান


অফিস শেষ। ব্যস্ত রাজপথ। মানুষ ব্যস্ত নিজ নিজ ঘরে ফেরায়। আকবও আজ ব্যস্ত খালার বাসায় যেতে হবে। বসন্তের শেষ বিকেল গুলো চমৎকার। না থাকে শীত, না থাকে গরম। প্রেমিকার রাগ ভাঙ্গানোর পর যেমন করে মিষ্টি হাঁসে, বসন্তের শেষ বিকেলের রোদও তেমন মিষ্টি। আজকের রোদে আকবের এক কদমও হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। প্রচন্ড মাথা ধরেছে। গাড়ীতে ওঠার অভ্যাস নেই- তবুও আজ উঠতে হবে। খালা অপেক্ষায় আছে তার সাথে আজ বিকেলে বাজারে যেতে হবে। উনি অপেক্ষা করছে এটা আকবের কাছে ব্যাপার নাহ। থাকুক অপেক্ষায়। অপেক্ষা না থাকলে মানুষ বেশি দিন বাঁচে না, কিন্তু খালার অনেক দিন বাঁচতে হবে তার বিশাল সম্পত্তি শিয়াল কুত্তার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।
আকব একটি লোকাল সিটিং গাড়িতে গিয়ে উঠলো। মাঝের একটি সিট ও শেষের কয়েকটি সিট ফাঁকা। আকব মাঝের সিটটায় গিয়ে কোন মতে বসলো।
-ভাই আমি মোটা মানুষ, আপনার বসতে সমস্যা হচ্ছে, বরং আপনি পিছনের সিটে গিয়ে আরাম করে বসুন। আকব একটা বেহায়া টাইপ হাঁসি দিয়ে বললো- না জনাব আমার সমস্যা নাই। আর আপনি তো মোটা নন, স্বাস্থ্যটা একটু ভাল, হে হে হে। আপনি মানুষের উপকার করা শুরু করেন। অন্যের উপকার করলে মানুষ চিকন হয়! পুলিশ দারোগারা মানুষের ক্ষতি করে। সবাই তাদের বদ দোয়া অভিশাপ গালাগাল করে এ জন্য তারা দিন দিন মোটা হয়!
লোকটি কড়া চোঁখে আকবের দিকে চেয়ে রইলো। আকব মনে মনে ভাবলো একটু বেশিই বলা হয়ে গেল। এই মূহুর্তে যদি তাকে হকচকিয়ে দেয়া না যায় তবে কপালে খারাপি আছে। আকব সেই চাহনি অগ্রাহ্য করে বললো, তুই রিটার্য়ারড় পুলিশ অফিসার। বাসায় বিবাহযোগ্য তিনটি মেয়ে আছে। তোর ভবিষ্যত অন্ধকার। এখনো তোর বউ তোকে গালি দেয়! লোকটি এক দৃষ্টিতে আকবের দিকে তাকিয়ে আছে। আকবও তাকিয়ে আছে। এটা কোন ছবির দৃশ্য হলে ডিরেক্টর সাহেব ক্যামেরা চারদিক দিয়ে ঘুরিয়ে তাদের চোঁখাচুখির দৃশ্যটি দেখিয়ে একটা ট্রাজেডি মূহুর্ত তৈরি করতেন। কিন্তু এটা কোন ছবি নয়, এটা বাস্তব। বাস্তবে আমরা ছবির চেয়ে ভয়ঙ্কর ট্রাজেডির মুখোমুখি হই। লোকটি পুরোপুরি বিভ্রান্ত! কারন আকবের কথা গুলো কাকতালিয়ভাবে পুরাপুরি সত্য হয়ে গেছে। বিভ্রান্ত হওয়া মানুষের চোঁখ বিড়ালের মত পিট পিট করে। লোকটির চোঁখও এখন পিট পিট করছে। মিন মিন করে হিমুকে জিজ্ঞেস করলো- ভাই, আপনি ক?
আকব কোন উত্তর দিচ্ছে না। মাথা নিচু করে আছে কারন এই মূহুর্তে মাথা ব্যাথা কমতে শুরু করেছে। অন্যের বিভ্রান্ত চেহারা আকবের মনে এক ধরনের আনন্দের অনুভূতি জাগায়, যে অনুভূতি মস্তিস্ক পুরো ঠান্ডা করে দেয়। চিন্তা করছে সামনের কোন জ্যামে গাড়ি থেকে নেমে যাবেন। আজ আর খালার বাসায় যাওয়া যাবে না।
-ভাই, শুধু এটা বলেন আমার ভবিষ্যত কি হতে পার?
-এই মূহুর্তে আপনারটা বলতে পারছি না তবে কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ির ভিতরের বসা এক জনের একটি চোঁখ এবং আরেক জনের একটি কান নষ্ট হয়ে যাবে! পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। গাড়ির সমস্ত যাত্রীরা হকচকিয়ে উঠলো। আকব ভাবলেসহীন। জানালা দিয়ে কলেজ ছুটি হওয়া ছেলে মেয়েদের দেখতে লাগলো। বাহ্! কলেজ ড্রেস পড়া মেয়েদের তো সুন্দর দেখাচ্ছ!
কিছু ছাত্র-ছাত্রী দ্রুত বাসের দিকে এগিয়ে আসছে সম্ভবত গাড়িতে ওঠার জন্য। ওদের কে আজ অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। মেয়েগুলো মাঝে মাঝে হেঁসে হেঁসে ছেলেদের গায়ের উপর ঢলে পড়ছে! হয়তো ছেলেরা দুষ্ট দুষ্ট কথা বলছিলো। এ বয়সের মেয়েরা একটু নুড গল্প শুনতে পছন্দ করে। কিন্তু কখনও ছেলেদের সাথে বলবে না। মেয়েরা বান্ধবীদের সাথে বলতে ও শুনতে অভ্যস্ত। আকব আজ হাওয়া কে আকাশী রঙের একটা থ্রি-পিচ পরতে বলবে। নীল আকাশটা আজ পাতালে নেমে আসবে গায়ের উপর গড়াগড়ি খাওয়ার জন্য। নাহ্ থাক, হাওয়াকে বলা যাবে না কারন হাওয়ারা কখনো ছেলেদের গায়ের উপর ঢলে পড়ে না।
আকব সামনের সিটের সাথে মাথা হেলান দিয়ে নিচু হয়ে বসে আছে। হঠাৎ এক লোক তার পায়ের কাছে পড়ে চিৎকার করতে লাগলো। তাকিয়ে দেখে বাম কানে হাত দিয়ে শুয়ে চিৎকার করছে এক ছাত্র। যাত্রীদের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল। কেউ বলছে- ভাল করেছে, শিক্ষা হওয়া দরকার। আবার কেউ বলছে- ঠিক হয়নি, ছেলেটি তো ইচ্ছা করে করেনি। কেন আপনি এত জোরে থাপ্পর দিলেন? কেউ শুনছে না কারো কথা। সবাই বিজ্ঞ! বিশৃঙ্খল পরিবেশে আমরা সবাই নেতা। সিগনাল ক্লিয়ার গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আকব গাড়ির বডিতে থাপ্পর দিয়ে বলতে লাগলো ওস্তাদ গাড়ি সাইট! গাড়ি সাইট! অবস্থা গুরুতর এদের দু'জন কে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে। ড্রাইভার গাড়ি থামালো। আকব ও রিটায়ার্ড পুলিশ মিলে ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। ঘটনার কারন জানার জন্য উৎসুক জনতার মাঝে ব্যাপক কৌতুহল।
হাসপাতালে আজ ধর্মঘট। ভুল চিকিৎসায় এক রোগি স্বর্গে চলে গিয়েছে। উত্তেজিত জনগনের হাতে কিছু ডাক্তার ব্যাপক উত্তম মাধ্যম খেয়েছে তার জেরে ডাক্তার এসোশিয়েশন আগামি তিন দিন ধর্মঘট ডেকেছে। অন্য রোগী বাঁচুক মরুক তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। রোগীর জীবন বাঁচানোর চেয়ে ডাক্তারদের সম্মান অনেক বেশি! তাছাড়া মৃত রোগীর কাছে প্রায় আট লক্ষ টাকা বকেয়া রয়ে গেছে। টাকাটা নিয়ে হাসপাতালের ডাক্তর সম্প্রদায় ব্যাপক চিন্তিত। ঠিকমত বেতনের টাকা বউয়ের হাতে দিতে না পারলে বউয়ের মন খারাপ। বউয়ের মন খারাপ মানে রাতে সেক্স বন্ধ। বিবাহিত জীবনে সেক্স বন্ধ মানে মাথা ও মন দু'টাই নষ্ট। সুতরাং এই মূহুর্তে ডাক্তরদের কাছে চিকিৎচার চেয়ে মাথা ও মন ঠিক রাখা জরুরি।
মিরপুর হাসপাতালে আরো একজন রোগী এলো। নাম সারাফত আলী, বয়স প্রায় সত্তর। এক চোঁখে মারাত্নক আঘাত পেয়েছে। তার ছেলে আকরাম হাসপাতালে তাকে নিয়ে এসেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেলো সারাফত আলীর চোঁখটি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় পচাঁনব্বই ভাগ। সারাফত আলী ও কলেজ ছাত্রের সিট পাশাপাশি। আকরাম ডাক্তারের সাথে কথা বলছিল- তার বাবার প্রতি, তাদের পরবর্তী করণীয় কি? এই ফাঁকে আকব এগিয়ে এলো সারাফত আলীর কাছে।
-চাচা মিয়া, সারা জীবন দুই চোঁখ দিয়ে অনেক জিনা করেছেন। লালসার চোঁখে ছোট বড় যুবতী মেয়েদের দিকে তাকিয়েছেন। এখন এক চোঁখ দিয়ে দেখবেন গুনা কম হবে, পুরা ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট হয়ে গেল। চাচা মিয়া এখন একটু জম্পেশ ঘুম দেন। ঘুমে সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যান এবং বলেন, 'বিধি আমার এ চোঁখ অন্ধ কইরা দে'। প্রচন্ড বাস্তবতার মধ্যে এক ধরনের ঘোর সৃষ্টি হয়। সারাফত আলীর মস্তিস্কে ঘোর তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। যে কোন সময় সে ঘোরের মধ্যে চলে যাবে। সারাফত আলীর কাছে এই মূহুর্তে আকবকে কোন এক অবতার মনে হচ্ছে!
রিটার্য়ারড় পুলিশ অফিসার বৃদ্ধ সারাফত আলীর দিকে এগিয়ে এলো। সারাফত আলীর চোঁখে যতটুকু ভীতি তারচেয়ে অফিসারের চোঁখে ভয়ঙ্কর ভীতি তৈরি হয়ে আছে। আকবের কথাই তার বেশি মনে পড়ছে। একটি চোঁখ ও একটি কান, একটি চোঁখ ও একটি কান, একটি চোঁখ ও একটি কান নষ্ট হবে কথাটি এখনো কানে ঢোলের মত বেজে চলছে। কোন কিছুতেই মনযোগ দিতে পারছে না। আশ্চার্য বিষয়! এই মূহুর্তে পরিবারের কোন কষ্টই তার কাছে বড় মনে হচ্ছে না। রিটার্য়ারড় পুলিশকে দেখে বৃদ্ধ কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বলতে পারছে না। আঙুলের কাঁপা কাঁপা ইশারায় বলতে চাইলো, ‘আকব কে’? বাকরুদ্ধ অফিসার কোন কথা বলতে পারলো না। শুধু এক বার আকবের দিকে তাকালো।
সন্ধার পর হাসপাতালে রোগীদের অনেক আত্নীয়-স্বজন আসলো। কিভাবে দুর্ঘটনা ঘটলো? ক্ষতিপূরণ আদায় হয়েছে কিনা? এখন কি হবে টাইপ আন্তরিকতা চলছে। বাচ্চারা আপেল কমলা নিয়ে দৌড়া-দৌড়িতে ব্যস্ত। বেশির ভাগ আত্নয়ীদের মুখেই হাঁসি। একে অপরের সাথে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে, আর কবে দেখা হবে ঠিক নেই। আত্নীয়-স্বজন অসুস্থ বা মৃত্যু হলে সবচেয়ে লাভ হলো অনেক দিন পর সবার স্বাক্ষাত পাওয়া যায়। আকব দুরে দাঁড়িয়ে আছে।
-বাস্তবতার নিষ্ঠুর নাটক চলছে। নাহ্! বেশিক্ষন এখানে থাকা ঠিক হবে না। তথ্য আইনে যে কোন সময় কট হয়ে যেতে পারি।
চোঁখ ও কান নষ্ট হওয়ার তথ্যটি আকবই সবার আগে সবাইকে জানিয়েছিলো। কাকতালীয় ভাবে ঘটনা গুলো ঘটে যাবে এটা নিজেও ভাবেনি। আকব দ্রুত হাসপাতাল ত্যাগ করলো।
দু'দিন পর ডাক্তার জানিয়ে দিলো যে, বৃদ্ধের চোঁখটি আর ভাল হবে না। ডাক্তার নিজেও অবাক! সামান্য একটি স্কেলের খোঁচায় কিভাবে চোঁখটি নষ্ট হয়ে গেল। বৃদ্ধের ছেলে ডাক্তারের কাছে পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। কলেজের চার পাঁচ জন ছাত্র-ছাত্রী দ্রুত গাড়িতে উঠতেছিল। এক জনের পিঠে ঝোলান ব্যাগের মধ্যে একটি স্টিলের স্কেলের কিছু অংশ ব্যাগের বাহিরে বের হয়ে ছিল। দ্রুত পেছনে যাওয়ার সময় সিটে বসা আমার বাবার চোঁখে ওই স্কেলের খোঁচা লাগে।
-ওহ্ মাই গড! তারপর?
আকরাম পাশের রোগীর সিট দেখিয়ে বললো, আমি বাবার অবস্থা দেখে মেজাজ হারিয়ে ছেলেটিকে জোরে একটি থাপ্পর দেই। এতে ছেলেটিরও একটি কান নষ্ট হয়ে যায়। ডাক্তার দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বললো সত্যিই আফসোস হয় যে, বর্তমানের আমরা টিনএজদের বেশি স্বাধীনতা দেই। মা-বাবারা সন্তানদের ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার উন্নতির জন্য পরীক্ষয় এ প্লাস পাওয়া ছাড়া অন্য কোন শিক্ষা দেয়া হয় না। পারিবারে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে তাদের সহজাত বুদ্ধি দিন দিন কমে যাচ্ছে। গাড়িতে উঠার সময় ওদের উচিত ছিল ব্যাগটাকে পিঠ থেকে নামিয়ে বুকের কাছে রাখা। আমাদের একটু অসাবধানতার জন্য জীবনের বড় ক্ষতি হয়ে যায়। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে কাউকে আঘাত করাও উচিত নয়। আপনার কাজটিও ঠিক হয়নি। বাচ্চা ছেলেটি ইচ্ছে করে আপনার বাবার চোঁখে আঁঘাত করেনি।
আকব হাসপাতাল ত্যাগ করলো। নো গাড়ি! অনলি হাঁটা-হাঁটি। আকব হাঁটছে খামার বাড়ির ফুটপাত ধরে। রাত ৯:০০ টায় আকবের মোবাইল বেজে উঠলো- ‘কিট ক্যাট কিট ক্যাট কিট ক্যাট’। খালার কল দেখে আকব কেটে দিল। খালাও জানে এক রিং এ কল রিসিভ করার মত এত ভদ্র পাত্র আকব নয়। খালা বিরতিহীন ভাবে রিং দিতে লাগলেন। নবম বারে আকব কল রিসিভ করলো। হ্যালোর পরিবর্তে বড় একটা গালি দিয়ে শুরু হলো খালার কথা।
তোরে ঝাড়ুর মধ্যে গু মাখাইয়া পিড়ানো দরকার। আকাশী রঙের কলেজ ড্রেস পরা একটি মেয়ে এসেছে বাসায়। মেয়েটির নাম হাওয়া। তুই নাকি আসতে বলেছিস। সো কোন রকম হাংকি পাংকি না করে দশ মিনিটের মধ্যে বাসায় চলে আসবি।
-ঠিক আছে খালা, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্য চলে আসছি বলে কল কেটে দিলো।
আকব হাওয়াকে কলেজ ড্রেস পড়ে কচি খুকি সেঁজে খালার বাসায় আসতে বলেনি। তবে প্রকৃতি অনেক সময় আমাদের মেসেজ রহস্যময়ভাবে, আমাদের প্রিয় জনের কাছে পৌছে দেয়। কিন্তু সাধারন মানুষ এই খবর জানে না। হাওয়ার মত অসাধারন মেয়েদের পক্ষেই এই খবর জানা সম্ভব।
-নাহ্! খালার বাসায় যাওয়া যাবে না। হাওয়াকে নিয়ে এত বড় হেলুসিয়েসন হতে দেয়া যায় না। কাকতালীয় ঘটনাকে বেশি পাত্তা দিতে নেই। তার চেয়ে বরং চন্দিমা উদ্যানে কোন এক নিশি পরীর সাথে জোছনা ভাগাভাগি করে দেখা ভাল।
-আকব হাঁটছে নিশি পরীর খোঁজে....

শরশ_দিগন্ত
Share on Google Plus

0 comments:

Post a Comment