“মানুষ তাঁর স্বপ্নের
সমান বড়, আবার কখনো কখনো তাঁর স্বপ্নের চাইতেও বড় । স্বপ্ন নেই এমন কোনো মানুষ নেই।
স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে” কথাগুলো বলেছিলেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, টেলিভিশন
উপস্থাপক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। ব্যক্তিগত,
পারিবারিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতি সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলিনে সফল এবং
একজন আদর্শ মানুষ।
জন্মঃ
আনিসুল হক চট্টগ্রাম
বিভাগের নোয়াখালি জেলায় ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশবের অনেকটা
সময় কাটে তার নানা বাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের
সোনাপুর গ্রামে।
পরিবারের বিবরণঃ
আনিসুল হক মধ্যবিত্ত
পরিবার থেকে উঠে আসা এক জ্বলন্ত প্রতিভা
তার পিতার নাম সৈয়দ
মঈনুদ্দিন হোসাইন ও মাতার নাম ফাতেমা জোহরা। স্ত্রী রুবানা হক। তিনি মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। তাদের তিন সন্তান- দুই মেয়ে (১) ওয়ামিক
উমাইরা (২) তানিসা ফারিয়ামান ও এক ছেলে- নাভিদুল হক। ওয়ামিক
উমাইরা স্নাতক শেষ করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের
সিমন্স কলেজ থেকে স্নাতক করেছেন তানিশা ফারিয়ামান। নাভিদুল হক বোস্টনের বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায়
উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে মোহাম্মদী গ্রুপের পরিচালক ও দেশ এনার্জি লি:
এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে কাজ করছেন। এছাড়া আনিসুল হকের ছোট ভাই আবু বেলাল
মোহাম্মদ শফিউল হক ছিলেন সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে দেয়া বক্তব্যে নিজের মাকে নিয়ে বলতে গিয়ে একটা গল্পও
শোনান তিনি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তিই ছিল আমার ‘মায়ের দোয়া। আমার কিছু হলেই
মায়ের পায়ের কাছে শুয়ে বলতাম, মা আমাকে একটা ‘ফু’ দিয়ে দাও। আমি তখন ম্যট্রিক পরীক্ষার্থী।
পরীক্ষার আগের রাতে আমার অনেক জ্বর। ১০৪ ডিগ্রী হবে। আমি সকাল বেলায় উঠে বললাম, মা
আমি তো আর পরীক্ষা দিতে পারবো না। মা বললেন, এটা হয় নাকি রে বাবা? তুমি যদি এবছর
পরীক্ষা না দাও, তাহলে তো তুমি ১ বছর ফেল করে যাবে। তখন আমি বললাম, আমার তো কোন
উপায় নেই মা। আমি তো চোখে কিছু দেখছি না। তখন মা আমাকে অনেক দোয়া করে একটা ফু
দিলেন। এরপর আমার হাত ধরে বললেন চলো যাই। আনিসুল হক সে গল্পে আরো বলেন, ‘ওই দিন
আমার ৩ ঘন্টার পরীক্ষা ছিল। কিন্তু ২ ঘন্টা পর আমি বেরিয়ে গেলাম। মা বললেন পরীক্ষা
ভাল হয়েছে বাবা? সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছো? আমি বললাম, না। মাত্র ৩৪ নম্বরের উত্তর
দিয়েছি। এরপর মা বললেন পাস কততে? আমি বললাম পাস ৩৩ এ। তোমার ফু তে আর কাজ হবেনা।
মা বললেন, আচ্ছা। কাজ না হোক, আসো আর একটা ফু দিয়ে দেই। তারপর, মা ওখানে দুই রাকাত
নামাজ পড়ে আমার গায়ে একটা ফু দিলেন। বিষয়টি কাকতালীয় হলেও সত্য যে, ‘ওই পরীক্ষায়
আমি ৩৪ সে ৩৪ নাম্বারই পেয়েছিলাম।’
আনিসুল হক মনে প্রাণে
বিশ্বাস করতেন, একটা মানুষের জীবনে মায়ের দোয়া এবং ছায়া অনেক বড় শক্তি। সব সময়
মায়ের দোয়া নিয়েই পথ চলতেন। প্রায় শবে বরাতের রাতে মা’য়ের পায়ের নিচে শুয়ে আনিসুল
হক মা কে বলতেন, মা তুমি আমার গায়ের উপর একটা পা রাখো আর আমাকে একটা ফুঁ দিয়ে দাও।
মা তাঁর পাগল ছেলের আবদার রাখতেন। আনিসুল হকের মা আর আট দশটা মায়ের মতো খুব
শিক্ষিত ছিলেন না। তারপরও আনিসুল হক প্রতিটি পদক্ষেপে মায়ের দোয়া নিতেন। মায়ের
আদেশ ও মতামত নিয়ে পথ চলতেন।
তিনি যখন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন তখন তিনি
মায়ের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেন। মেয়র নির্বাচন করার প্রস্তাব দেয়ার পর, তিনি বেশ দুশ্চিন্তায়
পড়ে গেলেন। মা নেই কার কাছে গিয়ে বলবেন তার দুশ্চিন্তার কথা? তিনি তার বাবার কাছে গিয়ে
বললেন, বাবা, কি করবো? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চান যে আমি মেয়র হই। বাবা বললেন, “তোমার
মায়ের কাছে যাও। মায়ের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াও, নিজেই বুঝতে পারবে কোনটা করা উচিত।”
প্রচন্ড মা ভক্তিতে তিনি অন্যরকম একটা শক্তি অনুভব করতেন। যে শক্তি মানুষকে সাহসী করে
তোলে।
শৈশব ও লেখাপড়াঃ
তার শৈশবের অনেকটা সময়
কাটে তার নানা বাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর
গ্রামে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক(সম্মান) ডিগ্রী এবং চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন।
কর্ম জীবনঃ
আনিসুল হকের কর্ম জীবন
ছিল সাত রঙ্গে রঙ্গীন রংধনর মত। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, টেলিভিশন
উপস্থাপক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র। ব্যক্তিগত, পারিবারিক,
ব্যবসায়ী, রাজনীতি সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলিনে সফল এবং একজন আদর্শ
মানুষ।
টিভি উপস্থাপকঃ
গত শতাব্দীর আশি থেকে নব্বই দশকে টিভি উপস্থাপক হিসেবে আনিসুল হক সুপরিচিতি
লাভ করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) এ তার উপস্থাপনায় 'আনন্দমেলা' ও 'অন্তরালে' নামের
দুটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পূর্বে বিটিভিতে
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুখোমুখি একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে তিনি বিশেষভাবে আলোচনায়
আসেন।
জীবনের প্রথম ব্যবসাঃ
লেখাপড়া শেষ করে আনিসুল
হক বেশ কয় বছর বেকার ছিলেন। চাকরি খুঁজতেন পাশাপাশি বিটিভিতে কাজ করতেন। বিটিভিতে
টুকটাক কাজ করার সুবাধে ২৫/২৬ বছর বয়সেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তার জীবনের
অনিশ্চয়তা দেখে তার বাবা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। একদিন তার বাবা তাকে কাছে ডেকে
বললেন, দেখো তুমি কী করবে? আমার কিছু টাকা আছে। আমি তোমাকে দিবো। এরপর ৪ বন্ধু
মিলে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এক বন্ধু সদ্য বিয়ে করা বউয়ের গহনা বিক্রি
করলেন, আরেকজন এক বছরের চাকরির জমানো টাকা দিলেন তাঁর আব্বা তাঁকে ডেকে বললেন, আমি
আমার পেনশনের টাকা থেকে কিছু টাকা তোমাকে দেবো। তুমি ঠিক করো তুমি কি করবে?
আব্বাকে জানালেন, পাট এর ব্যবসা করতে চান। আব্বা পাটের ব্যবসার জন্য তাঁকে ষোল
হাজার টাকা দিলেন। আনিসুল হক হিসাব করে দেখলেন এই টাকা দিয়ে দুই ট্রাক পাট কিনে
সাপ্লাই দিতে পারলে বেশ ভাল লাভ করা যাবে। সেই হিসেব কষে পাট কিনতে চলে গেলেন
টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে। পাট কেনার সময় স্থানীয় একজন বলছিলো, এখানে কিন্তু ট্রাক চুরি
হয়ে যায়। এই শুনে আনিসুল হক ভাবলেন, আব্বার সারা জীবনের পেনশনের টাকা দিয়ে পাট
কিনছেন। পাটের ট্রাক চুরি হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই তিনি উঠে বসলেন প্রথম
ট্রাকে। রাত ১১টায় ট্রাক ছাড়লো। তিনি প্রথম ট্রাকের চালকের পাশে গিয়ে বসলেন।
পিছনের ট্রাক সামনের ট্রাককে ফলো করে এগুতে থাকলো। রাত দুইটার দিকে মাঝপথে হটাৎ
ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভার জানতে চাইলেন, স্যার প্রশ্রাব করবেন? আনিসুল হক কিছু বুঝে
উঠার আগেই দরজা খুলে তাঁকে লাথি মেরে বাহিরে ফেলে দেয় ট্রাক চালক। দুই ট্রাক পাট
সেদিন রাতেই চুরি হয়ে যায়। জীবনের প্রথম ব্যবসা শুরুর আগেই হোঁচট খেলেন। এই ঘটনার
পর আব্বার কাছে গেলেন আনিসুল হক। তাকে আব্বা বললেন, তুমি ভাল করে, অন্যজন আব্বার
জমি বিক্রির টাকা আনলেন আর আনিসুল হক দিলেন আব্বার বাকি পেনশনের ৮৫ হাজার টাকা। সব
মিলিয়ে ৪ বন্ধু ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা জোগাড় করলেন। এরপর শুরু করলেন তাঁদের
সংগ্রামের জীবন। ১৮০ ফুটের একটি রুমে ৩ বছর ধরে ব্যবসা চালিয়েছেন। আর এখন তিন
বন্ধু মিলে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিককে কাজ দিয়েছেন। আনিসুল হক বিশ্বাস করতেন, স্বপ্ন
মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। তাই তিনি স্বপ্ন দেখতেন এবং স্বপ্নের বাস্তবায়নে
অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। সেই পরিশ্রম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে সফল করে
তুলেছে।
পোশাক ব্যবসায়ী হিসেবে আত্নপ্রকাশঃ
ব্যবসায়ী আনিসুল হক
আশির দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৬ সালে তাঁর নিজস্ব ব্যবসা
প্রতিষ্ঠান ‘মোহাম্মদী গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বস্ত্র ও পোশাক খাতে প্রায় ৭০০০ জন লোককে কর্মসংস্থনের ব্যবস্থা
করেন। তৈরি পোশাক ছাড়াও এ গ্রুপের রয়েছে বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন এবং
কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা। 'ডিজিযাদু ব্রডব্যান্ড লিমিটেড' ও 'নাগরিক টেলিভিশনের'
মালিকও তিনি।
শিখরস্পর্শী ব্যবসায়ী হিসেবে সুনাম অর্জনের পর আনিসুল হক ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে ২০০৫ থেকে ২০০৬
সালে বিজিএমই-এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন
এফবিসিসিআইর নির্বাচিত সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সার্ক
চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশে বেসরকারি
খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিআইপিপিএরও সভাপতিও ছিলেন বেশ
কিছু দিন।
রাজনৈতিক জীবনঃ
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলে
অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী
হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হয়। নির্বাচনের পূর্বেই তিনি ‘সমস্যা চিহ্নিত, সমাধান
যাত্রা’ নামের একটি ইশতেহার ঘোষণা করেন। রাজধানীকে একটি আধুনিক, পরিচ্ছন্ন ও
স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু বারবার
অপশক্তির কাছে থেকে বাধা পেয়েছেন। তবুও তিনি দমে যাননি, থেমে থাকেনি নগরের উন্নয়ণ।
সর্বদা ইশতেহারের দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনে অটল ছিলেন। তার বেশ কিছু উদ্যোগ অনেক
আলোচিত ও প্রশংসিত হয়।
মেয়র হিসেবে সফলতাঃ
দৃঢ় মনোবলের অধিকারী
আনিসুল হক অনেক অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে তোলেন। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার দুই
বছরেই ঢাকা উত্তরের রুপ বদলে দিতে শুরু করেন। সততা এবং সাহসিকতার জন্য প্রশংসা
কুড়িয়েছিলেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের টেন্ডার বাণিজ্য বন্ধ করে ক্রয় খাতে
স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনাই ছিল তার প্রধান চ্যালেঞ্জ। তাতে সক্ষমও হয়েছিলেন।
১। গাবতলী ও
আমিনবাজারের অবৈধ পাকিং বন্ধ করা। দূতাবাস পাড়ায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা। তেজগাঁও
ট্রাকস্ট্যান্ডের রাস্তা দখলমুক্ত করেছিলেন।
২। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন
এলাকার রাস্তার পাশে, দেয়ালে, বাসার ছাদে হাজার হাজার অবৈধ বিলবোর্ড ঢাকা শহরেরে সৌন্দর্য
নষ্ট করে দিয়েছিল। আনিসুল হক প্রায় বিশ হাজার বিলবোর্ড অপসারন করে শহরেরে প্রকৃত
রুপ ফিরিয়ে আনেন।
৩। শহরে উন্মক্ত স্থান
দখলমুক্ত করা, খেলার মাঠ, পর্যাপ্ত কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ, প্রধান সড়ক, শাখা
সড়ক এবং মহল্লার গলিতে বাতি স্থাপন, সংস্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা।
৪। নগরের সৌন্দর্য
বর্ধনে ‘সবুজ ঢাকা’ নামে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহন।
৫। ঢাকা উত্তর সিটি
কর্পোরেশন এলাকায় দশ লক্ষ গাছের চারা রোপনের উদ্যোগ গ্রহন করেন। তারমধ্যে উত্তরায়
বত্রিশ হাজার চারা রোপন করে যেতে পেরেছেন।
৬। জলাবদ্ধতা নিরসনে
পয়ঃনিষ্কশনে, বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় উন্নত ব্যবস্থা গ্রহন করেন।
৭। ঈদ-উর-আযহা এর পশুর
বর্জ সংগ্রহ ও পয়ঃনিষ্কশনের জন্য সিটি কর্পোরেশনে চুক্তিভিত্তিক অতিরিক্ত
পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োগ করা।
৮। ৬৬ টি সেকেন্ডারি
ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণ করেন। এতে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ টন সংগ্রহ করা হয়।
৯। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ
স্থানে উন্নতমানের ১০টি পাবলিক টয়লেট স্থাপন করেন।
১০। গুলশান এলাকায়
শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ‘ঢাকা চাকা’ নামে বিশেষ বাস সার্ভিস চালু করা হয়।
১১। ৫৫ টি ফুট
ওভারব্রিজ, দুটি আন্ডারপাস এবং পর্যাপ্ত জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ করা হয়।
১২। বনানীতে ২টি চলন্ত
সিঁড়ি নির্মাণ করেন।
১৩। নিরাপদ ঢাকা গড়ার
লক্ষে নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ৬৪২ টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেন।
১৪। নাগরিকের উন্নত
সেবা প্রদানের লক্ষে ‘নগর’ নামে একটি এ্যাপ চালু করেন।
দুরন্ত সাহসী এই
মানুষটি আরও অনেক সময়ের অভাবে করে যেতে পারেননি। মাঝেমাঝে হতাশ হয়েছেন রাজনীতির
কালো ছায়ায় পথ আটকে দিতো। আফসোস করে বলতেন, ইচ্ছা থাকা সস্ত্বেও অনেক কাজ করতে
পারছিনা। তবুও থেমে থাকেননি। সরকার ও জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা বরাবরং তাকে
অনুপ্রাণিত করেছেন।
তিনি পেশীশক্তির
রাজনীতিতে পা রাখেননি। নষ্ট রাজনীতির কাদা গায়েও লাগাননি। বরং রাজনীতির নামে যারা
অপরাজনীতি করছেন, তাদের জন্যও ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি
কর্পোরেশন মেয়র আনিসুল হক। তার চলে যাওয়ায় কাঁদছেন নগরবাসী। কাঁদছেন
অরাজনৈতিক-রাজনৈতিক মঞ্চের মানুষেরাও। কাঁদবেইতো মানুষ! তিনি তো সবার কাছে সজ্জন,
সাদা মনের প্রিয় মানুষ ছিলেন। আনিসুল হক এমন একটি নাম ভয়কে জয় করে উন্নয়নের মাঠ
প্রসারিত করেছেন। যে দলের সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে জিতলেন, উন্নয়ন প্রশ্নে সেই দলের
মানুষেরাই পথ আগলে ধরেন। অবরুদ্ধও হলেন। তবে নিরাশ হননি। সব বাধা পায়ে মাড়িয়েই
স্বস্তি দিতে চেয়েছিলেন নগরে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র
আনিসুল হক তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
আনিসুল
হকের কিছু অমৃত বচনঃ
তিনি স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করতেন। তরুণ-তরুণীদের মনে স্বপ্নের বীজে এঁকে দিতেন। শুধু স্বপ্ন দেখতেই
বলতেন না, বরং সেই স্বপ্ন পূরণে নিজেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে বলতেন। আনিসুল হক
নিজের স্বপ্ন মা বাবার স্বপ্নের সাথে সমন্বয় করেছিলেন। তরুণ-তরুণীদের মা-বাবার
স্বপ্নের সঙ্গে মিলিয়ে স্বপ্ন দেখার তাগিদ দিয়েছিলেন। এজন্য তার জন্ম
পঞ্চাশ দশকে হলেও বর্তমান আধুনিক যুগের তরুণ তরুণীদের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ রোল মডেল।
সারাদেশে বিভিন্ন
অনুষ্ঠান, সভা, সেমিনার, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি যে, উদ্দীপনামূলক বক্তব্য
দিয়েছিলেন তা আজও সবার মনে গেঁথে আছে। নিচে তরুণ তরুণীদের প্রতি তাঁর কিছু
মূল্যবাণ অমৃত বাণী তুলে ধরা হলঃ
১। “লাইফ ইজ আ ট্রিপ,”
ওই ট্রিপে কোনো ম্যাপ নেই। এই ম্যাপ নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়।
২। জীবনে বড় করে স্বপ্ন
দেখো।
৩। মানুষ তাঁর স্বপ্নের
সমান বড়, আবার কখনো কখনো তাঁর স্বপ্নের চাইতেও বড় । স্বপ্ন নেই এমন কোনো মানুষ
নেই। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
৪। চল্লিশ/পঞ্চাশ বছরে গিয়ে নিজেকে কোথায় দেখতে চাও, সে অনুসারে
স্বপ্ন দেখ, কাজ কর।
৫। মানুষ সংঘবদ্ধ হলে
পৃথিবী বদলে যেতে পারে। আর মানুষ যদি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, সৎ লক্ষ্য নিয়ে, সৎ চিন্তা
নিয়ে দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে তাহলে একটি দেশ পাল্টে যেতে পারে।
৬। জীবন সহজ নয়, জীবন একটি যুদ্ধের জায়গা।
৭। জীবনে একটি একটি করে
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়, জীবনে উপরে উঠার কোন ‘ইলেভেটর’ নেই।
৮। হাওয়া খেতে হলে নদীর তীরে যেতে হয়, পর্বত দেখতে হলে হিমালয়ে যেতে
হয় আর জীবনে ভাল মানুষ হতে গেলে ভাল মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, ভাল মানুষের বই পড়তে
হয়, তাঁদের জীবনী পড়তে হয়।
৯। লাইফের কোন ব্যাকস্পেস নেই, এর কোন কিছু ডিলিট করা যায় না। একবার
সামনে এগিয়ে গেলে তো গেলামই, কম্পিউটারের মতো ব্যকস্পেস দিয়ে আবার ফিরে আসার কোন উপায়
নেই।
অসুস্থতাঃ
২০১৭ সালের ২৯ জুলাই
নাতির জন্ম উপলক্ষে সপরিবারে আনিসুল হক যুক্তরাজ্যে যান। সেখানে হঠাৎে একদিন
অসুস্থবোধ করেন। পরিবারের সদস্যরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। আগস্ট মাসের ১৩ তারিখে
তাকে লন্ডনের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন তার মস্তিষ্কের
রক্তনালীর প্রদাহ (সেরিব্রাল
ভাস্কুলাইটিস) ধরা পড়ে। এরপর আইসিইউ তে রেখে চিকিৎসা চলতে থাকে। ৩১ অক্টোবর,
শরীরের একটু উন্নতি হলে তাকে আইসিইউ থেকে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু
২৮ নভেম্বর শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে আবার রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থেকে আইসিইউ তে
স্থানান্তর করা হয় ও লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
মৃত্যুঃ
২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর, লন্ডন সময় ৪:২৩ মিনিটে, বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার
রাত ১০টা ২৩ মিনিটে লন্ডনের ওয়েলিংট হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মুত্যুকালে
তার বয়স ছিল ৬৫ বছর।
২ ডিসেম্বর ২০১৭ আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজার পর তাকে বনানী কবরস্থানে
ছোট ছেলে শারাফ ও মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়। আমাদের মাঝ থেকে এত অকালেই বিদায় নিবেন প্রিয় মানুষটি এটা কেউ মেনে
নিতে পারছিলেন না। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এমন ক্ষমতা মানুষের নেই।
মেনে নিতে মন না চায়, হায়! তবুও মেনে নিতে হয়। রবার্ট ফাস্ট বলেছিলেন, “যে সব দৃশ্য আমরা খুব মন লাগিয়ে দেখতে
চাই সে সব দৃশ্য কখনো ভালভাবে দেখতে পারিনা সেই সব দৃশ্য অতি দ্রুত চোখের সামনে
দিয়ে চলে যায়।” তেমনি করেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। পৃথিবীতে বিখ্যাত ব্যক্তিদের
আগমন এমনই হয়। ধুমকেতুর মত এসে নক্ষত্রের মত চারিদিক আলোকিত করে উল্কার মত চলে
যাবে- এটাই যেন বিধাতার নিয়ম। কিন্তু তাদের কীর্তি রয়ে যাবে যুগ যুগ ধরে। তার
কাজের মাধ্যমেই বাংলাদেশের মানুষের মনে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। প্রিয় আনিসুল হক ভালো
থাকবেন ওপারে।
তথ্যসূত্র:-
চ্যানেল আই অনলাইন ও
প্রথম আলো পত্রিকা।
ইউটিউবে প্রচারিত
বিভিন্ন বক্তব্য ও লেকচার। এবং
উইকিপিডিয়া।
0 comments:
Post a Comment