প্রাচীনকালে মানুষ যখন শূন্য
আবিস্কার করতে পারেনি, তখনও গণনা পদ্ধতি ছিলো। পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ নিজেদের
স্থানীয় গণনা পদ্ধতিতে কাজ করতেন। কিন্তু শূন্য ছাড়া দৈনন্দিন জীবনের গণনা পদ্ধতি কী
ছিলো তা জানা যায়নি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের গ্রেট সম্রাট অশোকের সময়ে মানুষেরা
বড় বড় সংখ্যা অংকে না লিখে কথায় লিখতো। যেমন, সহস্র, অযুত, লক্ষ, নিযুত, কোটি ইত্যাদি।
কাগজে কলমে নবম শতক থেকে শূন্য ব্যবহারের কথা বলা হলেও এটি তারও আগে শতশত বছর আগে থেকে
ব্যবহৃত হয়ে আসছে বলে ধারণা করা হয়।
শূন্যের সঠিক উৎপত্তি কখন এবং
কার মাধ্যমে হয়েছিলো তা নিয়ে দ্বিমত আছে। তবে ধারণা করা হয় যে, প্রাচীন মিশরে, মেসোপটেমিয়ান
সভ্যতা এবং চীনে শূন্যের ব্যবহারের কথা শোনা যায়। এও ধারণা হরো হয় যে, শূন্য আবিস্কারের
পিছনে সাংস্কৃতিক কারণ থাকতে পারে। শূন্যতা ও চিরস্থায়ী/অবিনশ্বর এই ধারণাগুরোর প্রাচীন
ভারতীয়দের বিশ্বাসের একটি অংশ। সেভান তেকেই এসেছে শূন্যের ধারণা। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য
তথ্য হলো- সপ্তম শতাব্দীতে, ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত (৫৯৮-৬৬০ খ্রি:) সর্বপ্রথম
শূন্যের ধারণা প্রকাশ করেন। তিনি পাটিগণিতে শূন্যের লিখিত বিবরণ চিহ্ন আকারে প্রকাশ
করেন। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্রহ্মসিদ্ধান্ত’ বইতে শূন্যকে একটি সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ
করেন। তার শূন্যের ব্যাখ্যাকে আরও নির্ভরযোগ্য করে তোলেন ভারতার্ষের আরেক গণিতবিদ ও
জ্যোতিবিদ ভাস্করাচার্য (১১৪-১১৮৫ খ্রি:) তার ‘লীলাবতী’ গ্রন্থে। তিনি শূন্যেরে শক্তিময়তার
বিশ্লেষণ করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, পশ্চিমাদের
থেকে বহু শতাব্দী আগেই গণিতের অবিশ্বাস্য সব আবিস্কার করেছিলো ভারতীয় গণিতবিদরা। ভারতীয়রা
তৃতীয় শতক থেকেই দশমিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলো। কিন্তু তারা কীভাবে দশমিক পদ্ধতি খুঁজে
পেয়েছিলো সেটা জানা যায়নি।
শূন্যের আকৃতি প্রদান: ভারতীয়রা সর্বপ্রথম শূন্য সংখ্যাটি
খালি বা ফাঁকা বোঝাতে ব্যবহার করতো। সংস্কৃতি শব্দ ‘শ্যুন্যয়া’ (শ্যুন্য) যার অর্থ
ফাঁকা বা খালি ঘর। গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত শূন্যের জন্য একটি চিহ্ন তৈরি করেছিলেন- তা
হলো সংখ্যার নিচে একটি বিন্দু। এই বিন্দুটি তখন একটি সংখ্যা বা প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত
হলো। ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও গাণিতবিদ আর্যভট্ট শূন্য কে বিশ্বের সামনে ‘‘0”
(শূন্য) আকৃতি দিয়ে অমর হয়ে আছেন। দশম শতকে ‘‘0”
একটি নম্বর হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।
পরর্তীকালে ‘‘0”-র
ব্যবহারকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন রেনে দেকার্ত। তিনি স্থানাঙ্ক জ্যামিতির উদ্ভাবক
ছিলেন। যাকে আমরা এখন ‘Cartesian Co-ordinary system’ বলে জানি। এই স্থানাঙ্ক জ্যামিতির
সাহায্যে কোন জ্যামিতিক আকৃতিকে লেখচিত্র বা Graph এর সাহায্যে প্রকাশ করা যায় এবং
সেখানে মূল বিন্দু হিসেবে (0,0) স্থানাঙ্ককে ধরা হয়, যেটি
Descartes’s Origin নামে পরিচিত।
৯৭৬ সালে পারস্যের মুসলিম বিজ্ঞানী
মোহাম্মদ ইবনে আহমেদ আল-খাওয়ারিজমি তার বিজ্ঞানগ্রন্থ “বিজ্ঞানের চাবি”তে বলেন, “গানিতিকে
হিসাবের সময় যদি দশকের ঘরে কোন সংখ্যা না থাকে তাহলে সামঞ্জস্য রাখার জন্য একটি ছোট
বৃত্ত দিয়ে পূরণ করা যেতে পারে”। সেই ছোট বৃত্তকে তিনি ‘সিফার’ নামে অবহিত করেন। তার
সিফারই বর্তমান যুগে ‘জিরো’ বা ‘শূন্য’ নামে পরিচিত।
ইংরেজী শব্দ জিরোর ব্যবহার
পাওয়া যায় ১৫৯৮ খ্রীষ্টাব্দে। ইংরেজীতে জিরো শব্দটি এসেছে ভেনিশিয়া শব্দ জিরো থেকে
যা আবার ইতালিয় জিফাইরো থেকে পরিবর্তন হয়ে এসেছিলো। ইতালিয় জিফাইরো শব্দটি এসেছে আরবী
শব্দ সাইফার বা সাফাইরা শব্দ থেকে যার অর্থ “সেখানে কিছু ছিলো না”। এই শব্দটি প্রথমে
ভারতীয় সংস্কৃতি হতে অনুদিত হয়েছে। সংস্কৃতি শব্দ ‘শ্যুন্যয়া’ (শ্যুন্য) যার অর্থ ফাঁকা
বা খালি ঘর। ১৬০০ সালের দিকে বিজ্ঞানী নিউটন এবং দার্শনিক লাইবনিজ আলাদা আলাদা করে
জিরোর ব্যবহারের সমস্যার সমাধান করেন এবং পৃথিবীতে অফুরন্ত সম্ভাবনার দরজা খুলে দেন।
জিরোকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হলো এক নতুন বিষয় ‘ক্যালকুলাস’। যে ক্যালকুলেস ছাড়া আজ পদার্থ,
রসায়ন, পরিসখ্যান, অর্থনীতি- সব অচল। শূন্য নিজের শূন্যতা কাটিয়ে পূর্ণতা পেলো। তাই
শূন্যে আবিস্কারে ও ব্যবহারের সাথে বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিদদের ভূমিকা আষ্টেপৃষ্ঠে
জড়িয়ে আছে।
শূন্য হলো অসীম বা ইনফিনিটির প্রতীক: শূন্য
দিয়ে গুণ করলে গুণফল কী একই হবে?- এমন একটি প্রশ্নের সমাধান বের করতে গিয়ে আবিস্কার
হয় অসীম বা ইনফিনিটি নামেক গাণিতিক ধারণাটির। ১২ শতকের ভারতীয় গাণিতিক ‘ভাস্কর’ বিষয়টিকে
সামনে এনেছিলেন। পরবর্তীকালে বিখ্যাত গাণিতিক ও বিজ্ঞানীদের হাতে পড়ে ভাস্করের ধারণাটি
স্বতঃসত্য হিসেবে প্রমানিত হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, শূন্য
যখন থেকেই আবিস্কার হোক ও যে আবিস্কার করুক না কেন- শূন্য আবিস্কার পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের
জন্য চির আর্শিবাদ হয়ে আছে। শূন্য না থাকলে আধুনিক ইলেক্ট্রনিক্সের অস্তিত্ব থাকতো
না। শূন্য ছাড়া কোন ক্যালকুলাস নেই, যার অর্থ আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা অটোমেশন নেই।
আপনি এই মুহূর্তে যে মোবাইল বা কম্পিউটারে লেখাটি পড়ছেন তা কম্পিউটার বাইনারী- জিরো
থেকে সৃষ্টি। সুতরাং শূন্য না থাকলে আধুনিক বিশ্বের আধুনিক আবিস্কার হয়তো আলোর মুখ
দেখতো না।
তথ্যসূত্রঃ
www.vox.com/science-and-health/2018/7/5/17500782/zero
0 comments:
Post a Comment