চীনাদের চা খাওয়ার ইতিহাস চার হাজারের বেশী দীর্ঘ।
চা হচ্ছে চীনাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্যতম অপরিহার্য একটি পানীয়। চীনাদের একটি কথা
আছে যে, প্রতিটি পরিবারে জীবনের সাতটি প্রয়োজনীয় জিনিস হলো- জ্বালানী কাঠ, চাউল,
ভোজ্য তেল, লবণ ,সোয়াসস, ভিনিগার এবং চা। এই কথা থেকে চীনাদের জীবনে চায়ের গুরুত্ব
দেখা যায়। মেহমান আসলে তাকে এক কাপ সুগন্ধী চা দেয়া চীনাদের অতিথিকে সম্বর্ধনা
করার রীতি, চীনারা চা খাওয়ার সংগে সংগে অতিথির সংগে কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন।
চীনাদদের চা খাওয়ার ইতিহাস সুদীর্ঘ। খৃষ্টাব্দ
২৮০ সালের আগে দক্ষিণ চীনে উ নামে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। এই উ রাজ্যের রাজা
মন্ত্রীদের সংগে ভোজে অংশ নেয়ার সময় মন্ত্রীরা বেশী বেশী মদ খেয়ে নেশা করতেন।
তাদের মধ্যে উয়ে চাও নামে এক মন্ত্রী মদ খেতে পারতেন না, তাই রাজা তাকে মদের বদলে
চা খেতে অনুমতি দেন। এই সময় থেকে চীনের অনেক লোক চা দিয়ে মেহমানকে সম্বর্ধনা করতে
শুরু করেন। থান রাজবংশের সময় চা খাওয়া চীনাদের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। জানা
গেছে, চীনাদের এই অভ্যাস বৌদ্ধধর্মের সংগেও সম্পর্ক আছে। মন্দিরে সন্নাসীরা ধ্যান
করার সময় সন্ন্যাসীদের ঘুম- ঘুম ভাব দূর করার জন্য কড়া চা খেতেন। থান রাজবংশের
আমলে ধনী পরিবারে চা বানানো, চা খাওয়া ও বই পড়ার ঘর আছে।
খৃষ্টীয় ৭৮০ বছরে থান রাজবংশের চা বিশেষজ্ঞ লু ইউ
চা চাষ করা, চায়ের পাতা প্রক্রিয়াকরণ আর চা খাওয়ার অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে চীনের
প্রথম চা অভিধান লিখেছেন। সুং রাজবংশের সময় রাজা সুন হুই চুন সহস্তে চা বানিয়ে
মন্ত্রীদের আপ্যায়ন করেন। ছিং রাজবংশের সময় শুধু রাজপ্রাসাদের ভোজসভায় নয়, তখনকার
বিদেশী কুটনৈতিকদের আপ্যায়ন করার সময়ও চা পরিবেশন করা হয়। এখন চীনের নববর্ষ উত্সব
বা বসন্ত উত্সবের সময় বিভিন্ন সরকারী সংস্থায় চা চক্রের আয়োজন করা হয়। চীনে চা
খাওয়া ইতিমধ্যে এক সাংস্কৃতিক কর্মসূচীতে পরিণত হয়েছে। অনেকে চা বানানো ও চা
খাওয়াকে এক শিল্প মনে করেন। চীনের বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের ছোট-বড় চা দোকান আছে।
পেইচিংয়ের কেন্দ্রস্থলের ছিয়েনমেন রাস্তায় এক বড় চা দোকান আছে, নাগরিকরা সেখানে চা
খাওয়ার সংগে সংগে নানা ধরনের জলখাবার খান এবং সংগীত ও অপেরা উপভোগ করেন । দক্ষিণ
চীনের অনেক দর্শনীয় স্থানে পর্যটকদের সুবিধার জন্য চা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে,
পর্যটকরা সুগন্ধ চা খাওয়ার সংগে সংগে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
বিভিন্ন দেশের চা খাওয়ার অভ্যাস এক নয়। পেইচিংয়ের
নাগরিকরা ফুল চা পছন্দ করেন , সাংহাইয়ের নাগরিকরা সবুজ চা পছন্দ করেন, দক্ষিণ
চীনের ফু চিয়েন প্রদেশের অধিবাসীরা লাল চা পছন্দ করেন। কোনো কোনো জায়গায় চায়ের
ভিতরে কিছু মশলাও দেয়া হয়, যেমন হুনান প্রদেশের কিছু জায়গায় লবণ ও আদার চা দিয়ে
মেহমানকে আপ্পায়ন করা হয় । এই ধরনের চায়ের মধ্যে চা, লবণ, আদা ছাড়া ভাজা সোয়াবিন ও
তিলও দেয়া হয়, চা খাওয়ার সময় হাতের কাপ নড়তে হয়, চা খাওয়া শেষে স্থানীয় অধিবাসীরা
কাপের সোয়াবিন, তিল, আদা ও চায়ের পাতা এক সংগে মুখে চিবিয়ে চায়ের সুগন্ধ উপভোগ
করেন।
চীনের বিভিন্ন জায়গায় চা বানানোর পদ্ধতিরও নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য আছে। পূর্ব চীনের নাগরিকরা অতিথি আসার পর চা পাতা এক টিপোটে রেখে গরম
পানি ঢেলে দেন, কয়েক মিনিট পর টিপোট থেকে কাপে চা ঢেলে অতিথির হাতে দেন। দক্ষিণ
চীনের ফুচিয়েন প্রদেশের চাং চৌ শহরে চা খাওয়ার বাসনগুলো আর চা বানানোর নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য আছে।
চীনের বিভিন্ন জায়গায় চা খাওয়ার রীতিও একই নয়।
পেইচিংয়ে মেহমানকে দাড়িয়ে দু হাত দিয়ে স্বাগতিকের কাছ থেকে চায়ের কাপ নিতে হবে এবং
ধন্যবদ জানাতে হবে। দক্ষিণ চীনের কুয়াং তুং প্রদেশে স্বাগতিকের কাছ থেকে চায়ের কাপ
নেয়ার পর মেহমানরা সাধারণতঃ ডান হাতের আঙুল দিয়ে টেবিলে তিন বার নখ দিয়ে ধন্যবাদ
জানান। চীনের কিছু অঞ্চলে অতিথি কাপের চা শেষ করে যদি আরো চান, তাহলে তাকে কাপের
ভিতরে কিছু চায়ের পানি বাকী রাখতে হয়, স্বাগতিক তা দেখে কাপে আবার পানি দেবেন। যদি
অতিথি কাপের চা শেষ করে ফেলেন, তাহলে স্বাগতিক মনে করেন আপনি আর চা খাবেন না, তিনি
আপনার কাপে আর পানি দেবেন না।
চা বিশ্বে হাজার হাজার বছর ধরে জনপ্রিয়। প্রায়
১৭ শতক থেকে চীনে ঔষধি পানীয় হিসাবে চায়ের উদ্ভব হয়েছলো। চীন বিশ্বের যে কোনও দেশের
চেয়ে বেশি চা উৎপাদন করে (২৪,৭৩,৪৪৩ টন), তারপরে রয়েছে ভারত (১৩,২৫,০৫০ টন) এবং কেনিয়া
(৪,৩৯,৮৫৭ টন) রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান দশম স্থানে (৮১,৮৫০)। এছাড়া শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম,
তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার ও ইরান। তুরস্কের জনগণ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চা পানকারী
দেশ হিসেবে পরিচিত। একজন তুর্কি গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে ৬ কাপ চা পান করে।
তথ্য সূত্র-
China ABC- china Radio
worldatlas.com/articles/the-worlds--tea-producing-nations
0 comments:
Post a Comment