হযরত খানবাহাদুর
আহ্ছানউল্লা (রহ:) ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক, দার্শনিক,
সূফী ও সমাজহিতৈষী ছিলেন। ভারতবর্ষে পিছিয়ে থাকা মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে
অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
জন্ম ও পরিবারঃ হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রহ:) ১৮৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন এক শনিবার (প্রচলিত আছে
২৭ ডিসেম্বর) বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম- মুন্সী মোহাম্মদ মুফিজ উদ্দীন এবং মায়ের নাম
মোছাঃ আমিনা বেগম। তার পিতা একজন ধার্মিক, ঐশ্বর্যবান ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর
দাদা মুন্সি মোহাম্মদ দানেশও ছিলেন একজন ধার্মিক, ধনী ও দানশীল ব্যক্তি।
পিতামহের ইচ্ছানুসারে
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা মাত্র ১৬ বছর বয়সে ফয়জুননেছা মহারানির সাথে বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক কন্যা ও আট পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন।
কন্যা শৈশবেই মারা যান।
শিক্ষাঃ খান
বাহাদুর আহসানউল্লা (রহ:) ছিলেন তাঁর পিতামহের একমাত্র ছেলের বড় সন্তান। শৈশবকাল
থেকেই তাঁর বাবা এবং দাদা উভয়ই অত্যন্ত আগ্রহ ছিলো তাকে ভালো মত লেখাপড়া শেখাবেন।
এজন্য পাঁচ বছর বয়স পার হওয়ার আগেই তিনি পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। তাঁর শিক্ষা
জীবন শুরু হয় নলতা গ্রামেই। মতিলাল ভঞ্জ চৌধুরী নামে একজন শিক্ষকের কাছে তার প্রথম
শিক্ষার হাতেখড়ি পড়ে। প্রথমে নলতা মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়ে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের
চব্বিশ পরগনার টাকি উচ্চবিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেন। এরপর ১৮৯০ সালে কলকাতার লন্ডন
মিশনারী স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (বর্তমানে এসএসসি) পাশ করেন এবং বৃত্তি লাভ করেন।
১৮৯২ সালে হুগলী কলেজ থেকে এফ.এ (বর্তমানে এইচএসসি) পাশ করার পর ১৮৯৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি
কলেজ থেকে বি.এ এবং ১৮৯৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এম.এ পাস
করেন।
কর্মজীবনঃ খান
বাহাদুর আহসানউল্লা (রহ:) শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৮৯৬ সালে, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের
সুপার নিউমারারি শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবনের শুরু করেন। এরপর দীর্ঘ কর্মময় জীবনে
ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জের উপ-পরিদর্শক, চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিদর্শক এবং সবশেষে শিক্ষা
বিভাগের সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। কয়েক মাস পর বেতন
বাড়িয়ে তাকে ফরিদপুরের অতিরিক্ত উপ-পরিদর্শক নিযুক্ত করা হয়। ১৮৯৮ সালের ১
এপ্রিল এ তাকে অতিরিক্ত উপ-পরিদর্শক পদ থেকে প্রমোশন দিয়ে স্থায়ীভাবে উপ-পরিদর্শক
পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপরে, তিনি তুলনামূলকভাবে বৃহত্তর জেলা বাকেরগঞ্জের উপ-পরিদর্শক
হিসাবে পদে নিযুক্ত ছিলেন।
কিছুদিন পর শিক্ষা বিভাগীয় পরিদর্শন লাইন
ছেড়ে চলে আসেন শিক্ষকতা লাইনে। ১৯০৪ সালে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক
নিযুক্ত হন। উক্ত পদে তাঁর দায়িত্ব পালনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে ১৯০৭
সালে তাঁকে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ প্রদান করে। ডিভিশনাল
ইন্সপেক্টর পদে থাকা কালীন সময়ে তিনি ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম
ও নোয়াখালীর উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনায় তাঁর ব্যক্তিগত অবদান বিপুল ছিল।
তাঁর উদ্যোগে চট্টগ্রাম সিটির নিকটে শেওরাতলির বিশাল স্কুল নির্মিত হয়েছিল। এ
ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক এলাকায় তিনি হিন্দু ও মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য
বেশ কয়েকটি হোস্টেল তৈরি করেছিলেন। তিনি ১৯১১ সালের জুন মাসে জমিদার বা
বাড়িওয়ালাদের পরিত্যক্ত ঘরেও অনেক স্কুল নির্মাণ করেছিলেন; তিনি লন্ডনের রয়্যাল
সোসাইটির (এমআরএসএ) সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯১২ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতের
কেন্দ্রীয় শিক্ষা সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হন। তিনিই ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম ও
একমাত্র ব্যক্তি, যিনি তৎকালীন বাংলা ও আসাম সরকারের সহকারী জনশিক্ষা পরিচালক
নিযুক্ত হন। তিনি কিছুদিন জনশিক্ষা পরিচালকেরও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৯ সালে
সরকারি চাকুরি হতে অবসর গ্রহণ করেন এবং নজি গ্রাম নলতায় ফিরে আসেন।
উল্লেখযোগ্য সংস্কারসমূহঃ
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রহ)
এর পুরো জীবনটি শিক্ষা সংস্কারে ব্যয় করেছিলেন। তাঁর সময়ে, তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগের
কারণে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার হিন্দু ও মুসলিম শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিশেষ সংস্কার
করেছিলেন। নীচে তাঁর কিছু শিক্ষামূলক সংস্কার উল্লেখ করা হলো:
¨ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রত্যেক পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীর নাম লেখার রীতি প্রচলিত ছিল। অনেকের মতে সাম্প্রদায়িকতা
বিদ্যমান থাকায় হিন্দু ও মুসলিম পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব করা হতো। খানবাহাদুর
আহ্ছানউল্লা- (রহ) এর প্রচেষ্টায় প্রথমে অনার্স ও এম.এ পরীক্ষার খাতায় নামের পরিবর্তে
রোল নং লেখার রীতি প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীতে এই.এ এবং বি.এ পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীর
নাম লেখার রীতি রহিত করা হয়।
¨ সে সময় বাঙালি
মুসলমানদের মধ্যে ফারসি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষা শেখার প্রবণতা ছিল বেশি। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ
ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষা শিক্ষায় তাদের উদ্বুদ্ধ করেন। কলকাতার ‘মখদুমী লাইব্রেরী’ ও
‘এম্পায়ার বুক হাউস’ তাঁরই প্রতিষ্ঠিত।
¨ সে সময় হাই
স্কুল ও মাদ্রাসা থেকে পাশ করে ছাত্ররা কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেত না। উক্ত মাদ্রাসাগুলোর
শিক্ষার মানোন্নয়ন করেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা। ফলে মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্রদের
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
¨ তৎকালীন সব
স্কুল কলেজে তিনি মৌলবির পদ সৃষ্টি করেন এবং হিন্দু পণ্ডিত ও মৌলবির বেতনের বৈষম্য
রহিত করেন।
¨ মুসলিম ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ধারা নির্দিষ্ট হয়। বিদ্যালয়ের
সকল শ্রেণীর বৃত্তি বণ্টনের পূর্বে তার মতামত গ্রহণ করা হত।
¨ তিনি রাজশাহীতে অবস্থান কালে মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষার
প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করেন ১৯২৮ সালে মোছলেম এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠা
করেন। তিনি নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে সংগ্রামের মাধ্যমে মুসলমান ছাত্রদের
জন্য দ্বিতল ছাত্রাবাস ‘ফুলার হোস্টেল’ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া কলকাতায় মুসলিম ছাত্রদের জন্য ‘ইসলামিয়া
কলেজ’ নামে একটি স্বতন্ত্র কলেজ প্রতিষ্ঠা
করেন।
¨ তখন উর্দুকে ক্যাসিক্যাল
ল্যাগুয়েজ হিসাবে গণ্য করা হত না। ফলে পশ্চিম বঙ্গের উর্দু ভাষী
ছাত্রদেরঅসুবিধা হতো। তারই প্রচেষ্টায় উর্দু সংস্কৃতির স্থান অধিকার করে।
¨ তাঁর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই
আরবীর পাশাপাশি ইংরেজিতে শিক্ষার প্রবর্তনকারী নতুন স্কিম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ের "দ্বিতীয় ভাষা" হিসাবে আরবি মর্যাদাকে একীকরণে অগ্রণী
ভূমিকা পালন করেছিলেন।
¨ স্কুল ও কলেজগুলিতে তিনি মুসলিম
শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির রেশনটি সংশোধন করেছিলেন এবং এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে দরিদ্র
কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে বিনা বেতনে পড়াশোনা করতে পারে। তিনি
বিদেশে উচ্চতর শিক্ষার জন্য সরকারী ফেলোশিপ প্রাপ্তিতে মুসলিম শিক্ষার্থীদের যে প্রতিবন্ধকতা
রয়েছে তাও সরিয়ে দিয়েছিলেন।
শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর ‘টিচারস ম্যানুয়েল’ গ্রন্থে
তিনি লিখেছেন, মনুষ্যত্ব লাভ শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য। মনুষ্যত্ব লাভ করিতে হইলে
শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক এই ত্রিবিধ বৃত্তির সম্যক অনুশীলন আবশ্যক। তিনি তাঁর
‘শিক্ষা ক্ষেত্রে বঙ্গীয় মুসলমান’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শিক্ষার দুইটি উদ্দেশ্য- চরিএ
গঠন ও জীবিকা সংগ্রহ। শিক্ষাকে তিনি জাতীয় উন্নতির সর্বপ্রধান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান
হিসাবে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি এবং সম্পদ জনসাধারণের
জ্ঞান। শিক্ষার মাধ্যমেই এই জ্ঞানের বিকাশ সম্ভব। হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (রহ)
চেয়েছিলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে সম্পূর্ন আধুনিক। জ্ঞান বিজ্ঞানের সর্বশেষ
আবিস্কারের সাথে পরিচিত হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এজন্য তিনি শিক্ষা
সংস্কারের প্রতি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন।
ঢাকা
আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠাঃ ‘সষ্ট্রার এবাদত ও সৃষ্টের
সেবা’- এই মূলমন্ত্র নিয়ে ১৯৩৫ সালে নিজ গ্রাম নলতায় আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা
করেন। কালক্রমে তৎকালীন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুরুপ অনেক মিশন প্রতিষ্ঠিত
হয়। ১৯৫৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ‘ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। মিশনটি এখন দেশের বৃহৎ
উন্নয়ন সংস্থাগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছে। এটি সমাজকল্যাণ পরিদফতরে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক
সংস্থা হিসেবে নিবন্ধনকৃত। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের কার্যক্রম দেশে বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে।
আহ্ছানিয়া
মিশন ৪টি বিভাগে উন্নয়নের জন্য কাজ করছে- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা ও মানবাধিকার
এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। দারিদ্র্য বিমোচন, আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মসংস্থান, স্বাস্থ ও
স্যানিটেশন, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, বৃক্ষরোপন, গৃহসংস্থান, সকল প্রকার শিক্ষা
পদ্ধতির উন্নয়ন ও বিস্তার, শিক্ষা উপকরণ উদ্ভাবন, শিক্ষা সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ,
গ্রন্থ উন্নয়ন ও বন্ঠন এবং এতদ্সম্পর্কিত গবেষণা, জরিপ ও মূল্যায়ণ, প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, আই, টি ও কারিগরি শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান, ভকেশনাল ট্রেনিং কেন্দ্র ইত্যাদি ঢাকা আহ্ছানিয়া প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা
করছে । ইতিমধ্যে ঢাকা আহছানিয়া মিশনের উদ্যোগে “আহছানিয়া ক্যান্সার হাসপাতাল”
“আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি”প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রহ) বলেছেন,"মিশনের মূখ্য
উদ্দেশ্য স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টের সেবা। ইহার উদ্দেশ্য অতি ব্যাপক, সমগ্র মানব
সমাজের উন্নয়ন ও আধ্যাত্মিক জীবন গঠনের মহান দায়িত্ব লইয়া এই মিশন জন্ম লাভ
করিয়াছে। কোন বিশেষ সম্প্রদায়, কি বিশেষ জাতি, কি বিশেষ বর্ণে ইহা সীমাবদ্ধ নহে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠায় অবদানঃ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় অবদান ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
খসড়া বিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে উত্থাপিত হলে দারুন বিরোধের সৃষ্টি হয় এবং
পরে এটি বিবেচনার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রহ)
ছিলেন এই কমিটির অন্যতম সদস্য। তৎকালীন সময়ে অনেকেই চাননি যে, এই বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয়
হোক। কিন্তু বহু বিরোধীতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবশ্যকতা সমর্থন করে এর
অনুকলে বলিষ্ঠ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। যার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত
হয়। আফসোসের বিষয় যে, বর্তমান সময়ে অনেকেই জানে না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার
ক্ষেত্রে খানবাহাদুর
আহ্ছানউল্লা (রহ) এর অবদান।
বাংলা সাহিত্যে অবদানঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তাঁর লিখিত
অন্যান্য গ্রন্থগুলো ছাড়াও ‘বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য’ শীর্ষক গ্রন্থটি তার
বিশেষ স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর এ গ্রন্থে আছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর
প্রাজ্ঞতা ও সাহিত্য বিনির্মাণে তাঁর মূল্যবান দিকনির্দেশনা। তাঁর লেখা সব গ্রন্থে
আছে ভাষাশৈলী বির্নিমাণে তাঁর পান্ডিত্যের প্রমাণ। সেকালের অন্যতম শক্তিধর লেখক
হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) সমাজ ও দেশ, বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি,
ইতিহাস, শিক্ষা, ধর্ম, জীবন কথা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ৭৯টি অতি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা
করেন। এসকল গ্রন্থ ‘খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা রচনাবলী’ নামে ১২ খন্ডে প্রকাশ করা
হয়েছে।
সমাজসেবা ও সাহিত্য নিয়ে ’বঙ্গভাষা ও মুসালমান সাহিত্য’ গ্রন্থে তিনি
বলেছেন, আদর্শগতভাবে সাহিত্যের প্রধান
লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজসেবা । তবে দুর্ভাগ্যক্রমে, এই লক্ষ্য লঙ্ঘন অনেক সময় লক্ষ্য
করা যায়। স্বাদকে দূষিত না করে স্বাদকে আরও পরিশ্রুত করার উদ্দেশ্যে সাহিত্যের লক্ষ্য
করা উচিত। সাহিত্যের সহায়তায় আমাদের ভবিষ্যতের সমাজের উন্নয়নের পথকে পরিষ্কার করতে
হবে”। তার মখদুমী লাইব্রেরীর কার্যক্রম তৎকালীন মুছলিম
সমাজে সাহিত্য সৃষ্টি ও সাহিত্যের প্রসারের
ক্ষেত্রে একটি দ্রুত ও মৌলিক পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়েছিল। তিনি আত্মজীবনী সহ অনুন্য ১০৮ খানা গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু বইয়ের নাম হলো:
¨
জীবনী বিষয়ক
হজরত মুহাম্মদ (সঃ)
ইসলাম রবি হজরত মুহাম্মদ (সঃ)
বিশ্ব শিক্ষক
ইছলাম নবী
পেয়ারা নবী (শিশু সাহিত্য)
ছেলেদের মহানবী (শিশু সাহিত্য)
ইসলাম ও আদর্শ মহাপুরুষ (ধর্ম)
আল ওয়ারেস
AL-Waris
কুতুবুল আকতাব হাজী ওয়ারেছ আলী শাহ
হাজী ওয়ারেস আলী শাহ (সংক্ষিপ্ত)
হাজী ওয়ারেস আলী শাহ (অনুবাদ)
আমার জীবন ধারা
মোস্তফা কামাল
ইবনে ছউদ
দরবেশ জীবনী
হজরত মহর্ষি রুমি আলাইহের রহমত
হজরত ফাতেমা
আউলিয়া চরিত
মহানবীর কথা
হজরত মুহাম্মদ (সঃ)
ইসলাম রবি হজরত মুহাম্মদ (সঃ)
বিশ্ব শিক্ষক
ইছলাম নবী
পেয়ারা নবী (শিশু সাহিত্য)
ছেলেদের মহানবী (শিশু সাহিত্য)
ইসলাম ও আদর্শ মহাপুরুষ (ধর্ম)
আল ওয়ারেস
AL-Waris
কুতুবুল আকতাব হাজী ওয়ারেছ আলী শাহ
হাজী ওয়ারেস আলী শাহ (সংক্ষিপ্ত)
হাজী ওয়ারেস আলী শাহ (অনুবাদ)
আমার জীবন ধারা
মোস্তফা কামাল
ইবনে ছউদ
দরবেশ জীবনী
হজরত মহর্ষি রুমি আলাইহের রহমত
হজরত ফাতেমা
আউলিয়া চরিত
মহানবীর কথা
¨ ইতিহাস বিষয়ক
মোছলেম জগতের ইতিহাস
History of the Muslim World
ইসলামের ইতিবৃত্ত
আমাদের ইতিহাস (পাঠ্য পুস্তক)
ভারতের ইতিহাস (ইংল্যান্ডের ইতিহাস সম্বলিত)
রাজর্ষি আওরঙ্গজেব ও মোছলেম সভ্যতা (১ম খন্ড- জীবনী ও ২য় খন্ড- পাকিস্তান)
ইছলামের দান (মুছলিম মনীষীদের অবদান সম্পর্কিত)
মুছলিম জাহান (১ম, ২য় ও ৩য় খন্ড)
মুছলিম প্রাচীর ভূ-ভাগের মানচিত্র
সৌদি আরব
পরাবৃত্ত
মধ্য ও দূর প্রাচ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মধ্য ও দূর প্রাচ্যের মুছলিম রাষ্ট্র সমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
মোছলেম জগতের ইতিহাস
History of the Muslim World
ইসলামের ইতিবৃত্ত
আমাদের ইতিহাস (পাঠ্য পুস্তক)
ভারতের ইতিহাস (ইংল্যান্ডের ইতিহাস সম্বলিত)
রাজর্ষি আওরঙ্গজেব ও মোছলেম সভ্যতা (১ম খন্ড- জীবনী ও ২য় খন্ড- পাকিস্তান)
ইছলামের দান (মুছলিম মনীষীদের অবদান সম্পর্কিত)
মুছলিম জাহান (১ম, ২য় ও ৩য় খন্ড)
মুছলিম প্রাচীর ভূ-ভাগের মানচিত্র
সৌদি আরব
পরাবৃত্ত
মধ্য ও দূর প্রাচ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মধ্য ও দূর প্রাচ্যের মুছলিম রাষ্ট্র সমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
¨ কোরআন ও হাদীস বিষয়ক
কোরআন ও হাদীসের আদেশাবলী
কোরআনের সার
হজরতের বচনাবলী
কোরআনের শিক্ষা
কোরআনের বাণী ও একত্ববাদ
বাংলা হাদীস শরীফ (১ম ও ২য় খন্ড)
হাদীছ গ্রন্থ
সংক্ষিপ্ত হাদীছ
ইসলামী বিধান বিষয়ক[সম্পাদনা]
আল ইছলাম
নামাজ শিক্ষা (ধর্ম ও ফেকাহ)
নামাজের ছুরা
দোয়া ও দুরুদ
ইছলামের মহতী শিক্ষা
মোছলেমের নিত্য জ্ঞাতব্য
মহাপুরুষদের অমীয় বাণী (ধর্মীয় উপদেশ)
পাঁচ সুরা
ইছলামী তালীম
বাংলা মৌলুদ শরীফ
তালীমী দীনিয়াত
আরবী দোয়া ( বাংলা উচ্চারণ ও অনুবাদসহ)
ইছলাম ও জাকাত (জাকাত সমাজতন্ত্র)
দীনিয়াত (১ম-৪র্থ ভাগ)
কোরআন ও হাদীসের আদেশাবলী
কোরআনের সার
হজরতের বচনাবলী
কোরআনের শিক্ষা
কোরআনের বাণী ও একত্ববাদ
বাংলা হাদীস শরীফ (১ম ও ২য় খন্ড)
হাদীছ গ্রন্থ
সংক্ষিপ্ত হাদীছ
ইসলামী বিধান বিষয়ক[সম্পাদনা]
আল ইছলাম
নামাজ শিক্ষা (ধর্ম ও ফেকাহ)
নামাজের ছুরা
দোয়া ও দুরুদ
ইছলামের মহতী শিক্ষা
মোছলেমের নিত্য জ্ঞাতব্য
মহাপুরুষদের অমীয় বাণী (ধর্মীয় উপদেশ)
পাঁচ সুরা
ইছলামী তালীম
বাংলা মৌলুদ শরীফ
তালীমী দীনিয়াত
আরবী দোয়া ( বাংলা উচ্চারণ ও অনুবাদসহ)
ইছলাম ও জাকাত (জাকাত সমাজতন্ত্র)
দীনিয়াত (১ম-৪র্থ ভাগ)
¨ স্কুল মাদ্রাসার পাঠ্য বিষয়ক
পদার্থ শিক্ষা (১৯০৫)
দীনিয়াত শিক্ষা (১ম-৪র্থ ভাগ)
প্রথম পড়া
Child's Grammar
The Reader
The Primer
First Book of Translation
Second Book of Translation
পদার্থ শিক্ষা (১৯০৫)
দীনিয়াত শিক্ষা (১ম-৪র্থ ভাগ)
প্রথম পড়া
Child's Grammar
The Reader
The Primer
First Book of Translation
Second Book of Translation
¨
শিশু সাহিত্য বিষয়ক
মক্তব সাহিত্য (১ম-৩য় খন্ড)
বাংলা সাহিত্য (১ম-৪র্থ খন্ড)
প্রাইমারী সাহিত্য (১ম-৩য় খন্ড)
মক্তব সাহিত্য (১ম-৩য় খন্ড)
বাংলা সাহিত্য (১ম-৪র্থ খন্ড)
প্রাইমারী সাহিত্য (১ম-৩য় খন্ড)
¨ দর্শন বিষয়ক
ছুফি (তাছাওয়াফ)
সৃষ্টি তত্ত্ব
আমার শিক্ষা ও দীক্ষা (তাছাওয়াফ)
ছুফি (তাছাওয়াফ)
সৃষ্টি তত্ত্ব
আমার শিক্ষা ও দীক্ষা (তাছাওয়াফ)
¨ ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক
বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য
বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য
¨ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা নীতি বিষয়ক
টিচারর্স্ ম্যানুয়েল (১৯১৬)
নীতি শিক্ষা ও চরিত্র গঠন (ধর্ম ও নীতি)
শিক্ষা ক্ষেত্রে বঙ্গীয় মোছলমান
টিচারর্স্ ম্যানুয়েল (১৯১৬)
নীতি শিক্ষা ও চরিত্র গঠন (ধর্ম ও নীতি)
শিক্ষা ক্ষেত্রে বঙ্গীয় মোছলমান
¨ আহ্ছানিয়া মিশন বিষয়ক
আহ্ছানিয়া মিশনের মত ও পথ
আহ্ছানিয়া মিশনের মূলনীতি
আহ্ছানিয়া মিশনের মত ও পথ
আহ্ছানিয়া মিশনের মূলনীতি
¨ তাছাওয়াফ বিষয়ক
ভক্তের পত্র
প্রেমিকের পত্রাবলী
তরীকত শিক্ষা
ভক্তের পত্র
প্রেমিকের পত্রাবলী
তরীকত শিক্ষা
¨ পত্র সংকলন বিষয়ক
অমীয় বাণী
অমীয় বাণী
¨ বিভিন্ন ধর্মের আলোচনা বিষয়ক
ইসলামের বাণী ও পরমহংসের উক্তি
বিভিন্ন ধর্মের উপদেশাবলী
ইসলামের বাণী ও পরমহংসের উক্তি
বিভিন্ন ধর্মের উপদেশাবলী
¨ স্বাস্থ্য বিষয়ক
মানবের পরম শত্রু
মানবের পরম শত্রু
¨ ভ্রমণ কাহিনী বিষয়ক
হেজাজ ভ্রমণ
হেজাজ ভ্রমণ
¨
কবিতা বিষয়ক
গীত গুচ্ছ
গীত গুচ্ছ
সাফল্য ও পুরষ্কারঃ হযরত
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) তাঁর কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার স্বীকৃতি অল্প সময়ের
মধ্যেই অর্জন করেন। নিন্মে তার কিছু চুম্বুক
সাফল্য উল্লেখ করা হলো:
¨ খানবাহাদুর
আহ্ছানউল্লা (রহ) তাঁর কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার স্বীকৃতি অল্প সময়ের মধ্যেই অর্জন করেন।
১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তাঁকে 'খানবাহাদুর' উপাধি প্রদান করা হয়। তিনি চাকরিতে
প্রবেশের মাত্র ১৫ বৎসরের মধ্যে এই সাফল্য অর্জন করেন।
¨ তিনি সিনেট এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যও
নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর পূর্বে কোন মুসলমানকে এই সম্মানজনক পদ দান করা হয়নি।
¨ তিনি ১৯১৭-১৯১৮ সাল পর্যন্ত বাংলার মুসলমানদের সাহিত্য সমিতির
সহ-সভাপতি ছিলেন
¨ বাংলা সাহিত্যে
বিশিষ্ট ও বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলা একাডেমী তাঁকে ১৯৬০ সালে সম্মানসূচক
'ফেলোশিপ' প্রদান করেন। সমাজ সেবা ও সমাজ সংস্কৃতিতে বিশেষ করে দীন প্রচারের কাজে অবদানের
জন্য ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাঁকে ১৯৮৬ সালে মরণোত্তর পুরষ্কারে ভূষিত করে।
¨ ১৯৬০ সালে শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো মনোনীত হন।
আধ্যাত্মিক জীবনঃ খান বাহাদুর আহসানউল্লা (রহ) অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ ছিলেন। তাঁর
আধ্যাত্মিক সন্ধানে, তিনি অর্জনের একটি ভাল পরিমাপ পেয়েছিলেন। ১৯০৯ সালে তিনি তাঁর
আধ্যাত্মিক বায়াত পাটনার বিখ্যাত হজরত শাহ গফুর (রহ) এর হাতে পেয়ে কাদেরিয়া-ওয়ারেসিয়া সেলসেলার সদস্য
হন। আজ তিনি একজন অত্যন্ত সফল পিয়ার বা সাধু হিসাবে সকলের দ্বারা শ্রদ্ধাশীল। তবে,
তাঁর উপলব্ধি, চিন্তাভাবনা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের অভিনবত্বের জন্য, তাকে সেই সময়ের
অন্যান্য সমকক্ষদের সাথে একই লিগে স্থান দেওয়া যায়নি। তাঁর সাধুদের উঁচু অবস্থান
থেকে তাঁর অনুসারীদের সাথে যোগাযোগের পরিবর্তে তিনি সর্বদা তাদের বন্ধু হিসাবে উপস্থিত
হয়েছিলেন।
তাঁর
চরিত্রের মূলে ছিল খোদা প্রেম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
সুন্নতে নিজকে রঞ্জিত করে সৃষ্টির সকল কিছুতেই মাহবুবের অস্থিত্ব উপলব্ধি অন্বেষণে
সারাটি জীবন অতিবাহিত করেছেন। মানব ও সৃষ্টি কুল, মহান আল্লাহর অতি দয়া আর
ভালোবাসার সৃষ্টি, ছূফীবাদের এ অমোঘ সত্য বুকে ধারণ করে নিজের অবশিষ্ট যা ছিল সবই
উৎসর্গ করে গেছেন মানুষের এবং সৃষ্টির কল্যাণে। তাঁর দর্শনে কোন কিছুতেই ভেদাভেদ
ছিল না, কি উঁচুতে নিচুতে, কি ধনী আর গরীবে, কি সাদা আর কালোতে, কি শিক্ষিতে আর
অশিক্ষিতে, কি হিন্দু আর মুসলিমে, সর্বোপরি কি ধর্মে আর অধর্মে। তিনি তাঁর
মেধা,মনন আর কর্মে সকলের নিকট নিজকে সমভাবে উপস্থাপন করতেন। গরীব অসহায়,
বঞ্চিতদের প্রতি তাঁর আগ্রহের প্রাধান্য ছিল সীমাহীন।
’তরিকত শিক্ষা’ গ্রন্থে তিনি
বলেন, "আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের জন্য ধর্মের বিধি বিধানকে পরিমার্জন করার জন্য
ধর্মের নিয়ম অনুসরণ করা একান্ত প্রয়োজন। যে কেউ তাৎক্ষণিক আত্মা এবং চিরন্তন আত্মার
মধ্যকার সম্পর্ক খুঁজে পেতে চান, যিনি অনুভব করতে চান তাঁর সমস্ত সৃষ্টিতে সর্বশক্তিমানের
উপস্থিতি, যিনি এই অস্থায়ী পৃথিবীতে অনন্ত জীবনের স্বাদ পেতে চান, যিনি আন্তরিকভাবে
প্রার্থনা করতে চান, ধর্মের নীতিগুলি মেনে চলা তাঁর পক্ষে আবশ্যক"।
আহ্ছানউল্লা ধর্মপ্রাণ ছিলেন, কিন্তু
সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে আশ্চর্যরূপে মুক্ত ছিলেন। তাই কোরআনের বাণী ও পরম
হংসের ঐক্যকে অভিনন্দিত করতে তাঁর বাঁধেনি। প্রেমের দৃষ্টিতে তিনি সর্বশ্রেণীর
মানুষকে দেখেছিলেন। মুসলিম মুরীদের গৃহে পদার্পণ উপলক্ষে হিন্দু জমিদার গৃহ থেকে
আহ্বান এলে তিনি সানন্দে তাতে সাড়া দিতেন। তাঁর সুন্দর জ্ঞানগর্ভ উপদেশ ও চরিত্র
মহিমায় তিনি উপস্থিত হিন্দুদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
মানবাত্মা পরমাত্মা হইতে আগত এবং পরমাত্মার সাথে পূর্নমিলনই
মানবাত্মার চরম লক্ষ্য। মানবকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন সেই অনন্ত স্বত্তার, অনন্ত
গুনাবলীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। পরমাত্ত্বার সাথে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে "আহ্ছানিয়া মিশনের
মত ও পথ" গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ”আল্লাহ্ - নুরুন আলা-নূর, তিনি জ্যোতির্ম্ময়,
চিন্তাময়, যত আলম বা জগৎ আছে, সবাতে তিনি এবং সবার বাহিরেও তিনি; যেখানে ভূমি নাই,
পানি নাই, বায়ু নাই, সূর্য নাই, চন্দ্র নাই, নক্ষত্র নাই, সেখানেও তিনি বিদ্যমান।
তিনি অসীম, অচিন্ত্য, মানব চিন্তার বহির্ভূত। বান্দার রুহ সেই মহানূরের স্ফুলিঙ্গ
বা আকছ। পরমাত্মা উভয়ই নূরে নূরান্বিত। বান্দার রুহ দর্পণ স্বরুপ। যতই তাহার
কালিমা দূরীভূত হয় ততই মহারুহের আকছ তাহার উপর প্রতিভাসিত হয় এবং চিন্তাময়ের
সান্নিধ্য লাভ হয়। কুকার্য্য বা কুচিন্তা দ্বারা মানব রুহের কালিমা সঞ্চিত হয়। কালিমা
সঞ্চিত হইলে তাহার উপর মহারুহের আকছ প্রতিভাসিত হয় না। খোদাওয়ান্দ করিম হইতেছেন
রহমানুর রহিম। মানব সক্রিয় কালিমা সঞ্চার করিয়া যদি অনুতপ্ত হৃদয়ে তাঁহার দরবারে
রোনাজারি করে, তবে সারা জীবনের কলঙ্ক এক মুহুর্তে দয়াময় অপসারিত করেন। মানবকে চাই
ইন্দ্রিয়গুলিকে বশীভূত রাখে এবং শয়তানী খেয়ালতকে বর্জ্জন করে। যতই ইন্দ্রিয় বশীভূত
হইতে থাকিবে, ততই জ্যোতির্ময়ের জ্যোতি রুহের উপর প্রতিফলিত হইতে থাকে। মানব জীবন
ধন্য হয়, প্রেমময়ের সহিত প্রেমিকের লাগোয়া পয়দা হয়; প্রেমিক ও প্রেমময়ের দুরত্ব
লঘুকৃত হয়, বেহেশতি শান্তিতে বান্দার হৃদয় ভরপুর হয়। আশেক মাশুকের দুরত্ব লঘুকৃত
হয়। নফছ বা রিপুর যতই দমন হয়, রুহানী শক্তি ততই বৃদ্ধি পায় এবং তৎসহ মহব্বতের
আধিক্য জন্মে। মহব্বত গাড় হইলে মাহাবুব সদাই দৃষ্টিগোচর হইতে থাকে; কি রাত্রিতে কি
দিবাতে এবং স্বপ্নযোগে মাহাবুবের দিদার লাভ হয় ও অন্তরে বেহেশতী শান্তির উদয় হয়”।
ইসলামের গুরুত্ব বোঝার জন্য তিনি "ইছলাম ও আদর্শ
মহাপুরুষ" গ্রন্থে বলেছেন, ”ইসলাম একটি মহাসত্যের নাম। ইহার সংজ্ঞা প্রদান
সুকঠিন। যাহা অনন্ত-সম্ভুত, শান্ত সংজ্ঞায় তাহাকে লিপিবদ্ধ করিতে চেষ্ঠা
অর্ব্বাচীনতা। যে সত্য জগতের আদিকাল হইতে প্রলয়কাল পর্য্যন্ত ব্যাপ্ত, অসম্পূর্ণ
মানবীয় ভাষায় তাহার প্রকাশ অসম্ভব। কতিপয় গুনের সমষ্ঠিগত বিকাশকে ইছলাম আখ্যা
প্রদান করা ভুল। বরং যে জীবন্ত শক্তি এই সকল গুনাবলীকে সঞ্জীবিত করিয়া রাখে, তাহাই
প্রকৃত ইছলাম। ইছলামের মুলে অনন্ত প্রেম নিহিত। এই প্রেম স্বর্গীয়। ইহার ক্রম
বিকাশ জীবশ্রেষ্ঠ মানবের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। কতকালে মানব ইহার পূর্ণায়ত্ব লাভে
সমর্থ হইবে, তাহার ইয়াত্তা করা যায় না। যতই এই প্রেমের স্ফুরণ হয়, ততই ইছলামের
মাহাত্ন্য প্রকটিত হয়। যে অনন্ত শক্তি হইতে ইসলাম নিস্যন্দিত, ভাষা তাহার শক্তি
প্রকাশ করিতে অক্ষম। মানব এই শক্তির আভাষ জীবনের কোন বিশেষ সময়ে উপলব্ধি করিতে
পারে,কিন্তু ইহাকে পূর্ণ রুপে আয়ত্ত করা সাধ্যাতীত। হজরত মোহাম্মদ (স) জগতে যে
আদর্শ দৃষ্টান্ত রাখিয়া গিয়াছেন, মানব যুগে যুগে তাহার সান্নিধ্য লাভ করিতে পারে
কিন্তু পূর্ণত্বলাভ করিতে পারে না”।
শরীয়ত ও তরীকত এর গুরুত্ব অনুধাবন করা
যায় তার ”তরিকত শিক্ষা” নামত গ্রন্থে। তার মতে, নবীগণ উম্মতদিগের জন্য যে সকল
হেদায়েত করিয়াছেন, উহাই শরীয়ত নামে অভিহিত। শরীয়তের অন্তর্নিহিত নির্য্যাসের নাম
তরীকত। নামাজে কেব্লামুখে খাড়া হওয়া শরীয়ত, আর দেলের সহিত আল্লাহ্তা'লার তরফ
মোতওয়াজ্জ্বাহ হওয়া তরীকত। শরীরকে নাজাছাত হইতে পাক্ রাখা শরীয়ত, আর দেলকে
বদখেয়ালত হইতে পাক্ রাখা তরীকত। ছুরা ফাতেহা ও ছুরা এখলাছ মুখে পড়া শরীয়ত ও দেলের
সহিত একীন জানা যে, আল্লাহ্তা'লা সকল জগতের মালিক, সকল করুণার আঁধার, সকল দয়ার
নিদান, রোজ-কেয়ামতের কর্ত্তা, পাপ ও পূণ্যের বিচারক, তিনি ব্যতীত আর আমাদের
গত্যন্তর নাই, তাঁহারই করুণা ভিক্ষা করি, তাঁহারই মদদ্ প্রার্থনা করি, তাঁহারই প্রশংসা
কীর্ত্তন করি, তিনিই আমাদের একমাত্র হর্ত্তা, কর্ত্তা, ত্রাতা, তাঁহারই দরবারে
অনুতাপ করি, ক্ষমা চাই আর আত্মসমর্পণ করি, এইরূপে গদ চিত্তে স্বীয় ক্ষুদ্রত্ব মনে
করিয়া আত্ম-বিলাপ জ্ঞাপন করাই তরীকত। ছেজ্দা দেওয়া শরীয়ত আর আল্লাহ্তা'লাকে
সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, সর্ব্বমহান, সর্ব্বশক্তিমান মনে করিয়া স্বীয় অপরাধ স্মরণ করত:
তাঁহার দরবারে লুটিয়া যাওয়া তরীকত। তাশাহ্হুদ পড়া শরীয়ত; আর আমাদের মাওলা,
আমাদের শাফায়াতকারী, নবীশ্রেষ্ঠ, মহব্বতের প্রস্রবণ, হজরত রাছুলে করিম
আলায়হেচ্ছালাত ওয়াছ্-ছালামের উপর আল্লাহ্তা'লার করুণা-বর্ষণ প্রার্থনা করা ও
অন্তঃকরণের সহিত তাঁহার উপর ভক্তি প্রদর্শন করা তরীকত।”
সত্যতা, পবিত্রতা ও প্রেমিকতা’ অবলম্বন হলো তাঁর জীবনদর্শনের তিনটি
গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাঁর যাপিত জীবনে এ তিনটি বিষয়কে তিনি কেবল অমোঘ সত্য বলে গ্রহণ
করেন নি, তাঁর আধ্যাত্মীক-চেতনা ও যাবতীয় সেবামূলক কর্মকান্ডে প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা
করেছেন। ‘সত্যতা, পবিত্রতা ও প্রেমিকতা’ এই তিনটি বিষয়কে মহাপ্রভুর সাথে সাযুজ্য লাভের
অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নবী করীম (সঃ) এর উপর হজরত খানবাহাদুর
আহ্ছানউল্লা (রঃ) প্রগাঢ় ভক্তি ছিল। এক মুহূর্ত নবীজীর স্মরণ থেকে বিচ্যূত হতেন না।
অনুভব, অনুভূতি ও অর্ন্তগত দৃষ্টির সীমানায় তিনি রসুলে করীম (দ:) কে অনবরত স্মরণ করেছেন,
সীমাহীন মহব্বতের আলোয় তাঁকে সর্বক্ষণ অবলোকন করেন। নবী প্রেমে নিমজ্জিত সাধক দরবেশ হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা
(রঃ) এর তাঁর সমগ্র জীবনে অত্যন্ত- ভক্তি ও আনুগত্য দিয়ে মিলাদ-মাহফিল আয়োজন করেছেন।
এযেন তার জীবন পঞ্জির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়োজন ও উৎসব। মিলাদ শরীফে যোগদানের
যেকোনো আমন্ত্রণকে তিনি সাদরে গ্রহণ করতেন। তিনি জীবনে অসংখ্য মিলাদ-মাহ্ফিলে নেতৃত্ব
দিয়েছেন। তাঁর পরিচালিত মিলাদ-মাহ্ফিলে যেমন উপস্থিত হয়েছেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লার
মতো বহু ভাষাবিদ পন্ডিত তেমনি সমাবেত হয়েছেন সমাজের নিরক্ষর দীনহীন হাজারও মানুষ।
মৃত্যুঃ খানবাহাদুর
আহসানউল্লা (রহ) ৯২ বছর বেঁচে ছিলেন। এই মহান ব্যক্তিত্ব সুলতান ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন। আদর্শের মৃত্যু
নেই, তিনি পর্দার অন্তরালে চলে গেলেও থেমে থাকেনি সমাজ বিনির্মাণে তাঁর কর্মসূচি, তাঁর
মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন সহ শতাধিক শাখা মিশন সামাজিক
ও আধ্যাত্মিক জীবন গঠনের জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে।
হযরত খানবাহাদুর আহসানউল্লা সমাধি/নলতা শরীফঃ হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানুল্লা (রহ) পরলোক-গমনের
পর মওলানা আকরাম খাঁ দৈনিক আজাদের (২৮শে মাঘ, ১৩৭১) যে সম্পাদকীয় নিবন্ধ রচনা করেন,
তার অংশ বিশেষ তুলে ধরা হল- “এই আন্দোলন ইতিহাস কাহারো একক কর্মধারার বৃত্তে সীমাবদ্ধ
নহে। বহুজনের কর্মে ও সাধনায়, ধ্যানে ও জ্ঞানে’ সাফল্য ও ব্যর্থতার যে আন্দোলন মুসলিম
জাতির মূল জীবন প্রবাহের অঙ্গীভুত হইয়া পড়িয়াছে, তাহার পরিপূর্ণ ইতিহাস যেদিন লিখিত
হইবে সেইদিন খানবাহাদুর আহ্ছানুল্লা সাহেবের ভুমিকা যথাযথ গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভাব
হইবে। দীর্ঘদিন তিনি বাঁচিয়া গিয়াছেন এবং জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে তিনি ইসলাম ও মুসলিম
সমাজের নীরব কর্ম সাধনায় আত্মনিয়োগ করিতে পারিয়াছিলেন, ইহা আল্লাহর কম মেহেরবাণী নহে।
তাঁহার মৃত্যুতে সমাজের একটি দিক সম্পুর্ণরুপে শূন্য হইয়া গেল”।
তাঁর পাক রওজা শরীফকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক
পরিবেশ, পাশাপাশি মানব সেবার একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত। প্রতিদিন মানুষ জেয়ারত করতে আসেন
তাঁর পাক রওজা শরীফে। অনুষ্ঠিত হয় সাপ্তাহিক ও মাসিক নানাবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বিশেষ
ব্যবস্থা আছে দরবারে আগত নরনারীদের জন্য গেস্ট হাউজের। পবিত্র রমজান মাসে সারা মাসব্যাপী
চলে এফতারি, তারাবি, এতেকাফ শরীফের বিশেষ আয়োজন। রমজান মাসে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার
রোজাদার একত্রে বসে ইফতারি করেন। এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইফতারির জমায়েত । হজরত খানবাহাদুর
আহ্ছানউল্লা (রহ) এর জন্ম মাসে কেন্দ্রীয় মিশনসহ সকল শাখায় মিলাদ-মাহফিল, সেমিনার ও
মানব সেবার আয়োজনের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করেন। কেন্দ্রীয় মিশন ডিসেম্বর মাসের প্রতি
শনিবার এক একটি চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করে থাকে। প্রতি বৎসর ২৬, ২৭, ২৮ মাঘ যথা ৮, ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি উৎযাপিত
হয় ওরছ মোবারক। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলনে এটি প্রেমিকের মিলন মেলায় পরিণত
হয়।
তথ্য সংগ্রহঃ
‘সমাজ
শিক্ষক আহ্ছানউল্লা - ড. সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়
’তরীকত
শিক্ষা’ - খানবাহাদুর
আহসানউল্লা (রহ)
’আহ্ছানিয়া মিশনের মত ও পথ’ - খানবাহাদুর আহসানউল্লা (রহ)
’ছুফি (তাছাওয়াফ)’ - খানবাহাদুর আহসানউল্লা (রহ)
’সৃষ্টি তত্ত্ব’ - খানবাহাদুর আহসানউল্লা (রহ)
বিভিন্ন ব্লগ এবং উইকিপিডিয়া থেকে
0 comments:
Post a Comment